নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। সে সময় প্যারিসে অবস্থানরত ড. ইউনূসকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি ওঠে আন্দোলনরত ছাত্র ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। অবশেষে কোটি মানুষের প্রত্যাশা ও সমর্থনে তিনি দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। এর তিন দিন পর, ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ নিয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই দিন গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে সরকারের যাত্রা শুরু হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনের পেছনে ছিল দীর্ঘ ৩৬ দিনের গণঅভ্যুত্থান, যেখানে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হতাহত হন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। ওই দিনকে সরকার ‘গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে পালন করে এবং এই বছরের ৫ই আগস্ট সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে জাতির সামনে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপন করে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে শুরু থেকেই মানুষের মনে জেগেছিল পাহাড়সম প্রত্যাশা। সেই সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। মানুষ হিসাব করছে—কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম; কেন পেলাম না।
দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই ড. ইউনূসের সামনে যে বড় চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায়, তার অন্যতম ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনর্গঠন। তখনকার সময়ে পুলিশ প্রশাসন ছিল প্রায় অচলাবস্থায়। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই স্পষ্ট জানিয়ে দেয়—দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা কঠোর অবস্থান নেবে। তবুও নিরাপত্তা বাহিনীকে নতুনভাবে সংগঠিত করে জনগণের আস্থা ফিরে পেতে সরকারকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে।
প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয় সন্ত্রাস দমন, সীমান্ত এলাকায় অপরাধ ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং শহরাঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদারে। বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে একাধিক জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম কার্যকরভাবে দমন করা হয়।
রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নজরদারি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। সীমান্ত অঞ্চলে পরিচালিত বিশেষ অভিযানে উদ্ধার হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র ও মাদক। বিশেষ করে টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়।
এদিকে অনলাইন জালিয়াতি, হ্যাকিং এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ভঙ্গের মতো অপরাধ মোকাবিলায় সাইবার ক্রাইম ইউনিট সক্রিয়ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভুয়া তথ্য ছড়ানো ও অনলাইন প্রতারণা রোধে নিয়মিত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ প্রথমে ছয়টি কমিশন গঠন করে। পরে ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন’, ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন’, ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’, ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন’ ও ‘স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন’ যুক্ত হওয়ায় কমিশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১টিতে।
এসব কমিশন এরইমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে রয়েছে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ। কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ রয়েছে। সেগুলোর দিকে সুনজর রয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজও এগিয়ে চলেছে। নানা সংকট, সংশয়ের পরেও তারা চলতি জুলাইয়ের মধ্যেই একটি চূড়ান্ত রূপরেখা দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সংসদীয় ব্যবস্থা আরও কার্যকর করার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কারের সুপারিশও রয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে বিচারকদের নিয়োগ ও প্রেষণ নীতিতে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যকারিতা বাড়াতে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এই সংস্কারগুলোকে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে একটি সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। লক্ষ্য- ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি জাতীয় অঙ্গীকারপত্র চূড়ান্ত করা, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো সই করতে পারে।
কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েক দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরই মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে আলোচনা এগিয়েছে: রাষ্ট্রের মূলনীতি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি এবং নারী প্রতিনিধিত্ব।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, মতপার্থক্য থাকলেও আলোচনার প্রক্রিয়া ইতিবাচকভাবে এগোচ্ছে। কমিশন কোনও কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না; বরং অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই এক বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন মনে করা হচ্ছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বাজেট প্রণয়ন, যা কার্যকর হয়েছে গত ১ জুলাই থেকে। এক্ষেত্রে দাতাগোষ্ঠী বিশেষ করে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুসরণ করে দেশীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদানে যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সদ্য সমাপ্ত জুনে দেশের সেই ডাবল ডিজিটের মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। বাজার তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা এবং মুদ্রানীতিতে কিছু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের আস্থা বৃদ্ধির ফলে রিজার্ভে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। গত অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেকর্ড ৩০৩৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা রপ্তানি আয় প্রায় ৯ শতাংশ বাড়িয়েছে। টাকার মানও ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে। গত ১১ মাসে বৈদেশিক ঋণদাতাদের কাছে ৪ বিলিয়ন ডলার সুদ ও মূলধন পরিশোধ করা হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
সরকারের বড় সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি হলো বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, সদ্যবিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ ৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) ছিল ১২৭ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৪১ কোটি ৫৪ লাখ ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬০ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। তার আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৭১ কোটি ডলার। করোনার সময়ে ২০২০-২১ অর্থবছরেও বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৩২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছিল ১২০ কোটি ডলার। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। গত ১৪ বছরের মধ্যে বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরেও দেশে ১২০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। এরপর আর কোনও অর্থবছরে এর চেয়ে কম বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। আর এবার সেটা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
জানা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগ ও পুনর্বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম বিনিয়োগ পেয়েছে। গত অর্থবছরের শুরুতে জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে প্রথম প্রান্তিকে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল মাত্র ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। আর ছয় মাসে হয়েছিল ৫৯কোটি ডলার।
গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২১ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এসেছিল ৩৩ কোটি ডলার। এ হিসাবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৩৭ শতাংশ কম। তবে গত অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের চেয়ে বিদেশিদের পুনর্বিনিয়োগ বেশি হয়েছে। প্রথম ছয় মাসে পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ডলার।
এদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ কর ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে দেশে আয়োজন করা হয়েছিল ইনভেস্টমেন্ট সামিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। সেখানে ব্যাপক সাড়া মিলেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। দেশের রফতানি খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পকে চাঙা করতে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতাও কাজ করছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ইউনূস সরকারের গত এক বছরের অন্যতম বড় সাফল্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে। মানবাধিকার ইস্যুতে সরকারের অবস্থান স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ার লক্ষ্যে আলোচনা চলছে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ভবিষ্যতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একইসঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতেও বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে সরকার কৌশলী ভূমিকা রাখছে।
সরকারের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে, রমজানের আগে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৬ আগস্ট নির্বাচন কমিশনে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করা হবে।