মুক্তবাণী অনলাইন:
১৯৮১ এর ৩০ মে এই দিনে বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষক, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একদল বিপথগামী সৈনিকের বুলেটের আঘাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে শাহাদত বরণ করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া বগুড়া জেলার বাড়বাড়ি গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে ১৯৫৩ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে লাহোরের খেমকারান সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে গণঅভুত্থানের সময় ঢাকার জয়দেবপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন জয়দেবপুরের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করেই পূর্ববঙ্গের সর্বত্র ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। জিয়াউর রহমান ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ সালের সেই উত্থাল সময়ে তিনিই সর্বপ্রথম ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সেই সাথে চট্টগ্রাম সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পরে ১৯৭৮ সালের ৩ রা জুন জনগণের সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে জয়ি হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন।
শহীদ জিয়া খুব অল্প সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে নেতৃত্ব দেন। ৭৮-৮১ এই কয় বছরে তিনি একজন সামরিক অফিসার হওয়া সত্ত্বেও গণমানুষের এতটা কাছে তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন যা বাংলাদেশের অতীত এবং বর্তমানের কোনো প্রেসিডেন্ট এমন উচ্চতায় পৌঁছতে পারেননি। জিয়া নামটির সাথে এদেশের মানুষ অনেক পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন। তিনি যখন পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেন তারপর ভারতের সাথে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত একটি ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। সেই যুদ্ধে ব্যাপক বীরত্বের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে প্রথম ‘হিলাল-ই-জুরআত’ খেতাবে ভূষিত করেন। এছাড়াও জিয়াউর রহমান এর ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি ‘সিতারা-ই-জুরআত’ এবং নয়টি ‘তামঘা-ই জুরআত’ পদক লাভ করেন। সেই থেকে তাঁর অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের সাথে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে। ৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। পরবর্তীতে তাঁকে রাস্ট্রীয়ভাবে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়। শহীদ জিয়া অসীম সাহসের অধিকারী ছিলেন। মুসলিম জাতিসত্ত্বায় বিশ্বাস করতেন। ক্ষমতার অল্প কিছুদিনের মধ্যে দেশে শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই নয়, তিনি ইসলামীদলগুলোকে ব্যাপকআকারে রাষ্ট্রীয়কাজকর্মে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। তাঁর আমলেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইসলামপন্থীরা ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ পায়। তিনি দেশের মেধাবী ও তরুন সমাজকে রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের প্রেরণা যোগাতে ‘হিযবুল বাহার’ নামে এক জাহাজে সামুদ্রিক অভিযানে ছাত্রদের সাথে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর খাল-কাটা কর্মসূচী মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে। নদী মাতৃক এই বাংলাদেশে নদ-নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় কৃষি কাজের খুব ক্ষতি হচ্ছিল। তিনি এই কর্মসূচীর মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে অংশগ্রহণের প্রেরণা যোগাতে সক্ষম হন। তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক বড় বড় ওয়াজ মাহফিলে গিয়েও হাজির হতেন। এছাড়া তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি অবদান হলো- সংবিধানে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে এদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয় নির্ধারণে বিরাট ভূমিকা রাখেন। ৪টি মূলনীতির চমৎকার ব্যাখ্যা দেন। পাশাপাশি সংবিধানের শুরুতেই তিনি এই মর্মে ঘোষণা দেন যে, এই সংবিধানের মূল ভিত্তি হইবে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস।’ এর মাধ্যমে তিনি যে সত্যিকার অর্থেই একজন প্রকৃত ঈমানদার ছিলেন তার প্রতিফলন ঘটে। সংবিধানে অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সাথে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তাঁর চিন্তা ও পরামর্শেই দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গঠিত হয়। এটা ছিল দূরদর্শিতার ফল। বড় দেশগুলোর সাথে বড় দেশগুলোর সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের গভীর ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকেই এই সংস্থাটি গঠিত হয়েছিল। যদিও ভারত এই সংস্থাটিকে আজ প্রায় নিস্ক্রীয়করে রেখেছে। তিনি আরব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তাঁরই পরামর্শে আরাফাহ ময়দানে আজ নিমগাছের বাগান দেখা যায়। আমাদের দেশ থেকে হাজি সাহেবানগণ যখন পবিত্র হজের সময় আরাফার ময়দানে এই গাছের নীচে ছায়া লাভ করেন, তখন শহীদ জিয়ার কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধেও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সর্বোপরি, তিনি বাংলাদেশ যে একটি সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন দেশ সেটা উপলব্দি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন। এতে করে প্রতিবেশি বৃহৎ দেশটি তাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তিনি বাংলাদেশের ৮ম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামের বিষয়ে তিনি ছিলেন বড় উদার। ইসলাম বিষয়ে তিনি কখনো ছাড় দেননি। মুসলিম জাতিসত্ত্বার বিষয়টি তাঁর রক্তমাংসের সাথে মিশে গিয়েছিল।
তাঁর সময়েই বাংলাদেশ স্বাধীন কূটনীতি চর্চা শুরু হয়। এর আগে বাংলাদেশ যেন ভারতীয় কলোনী হিসেবে গড়ে উঠেছিল এমন মনে করা হতো। শহীদ জিয়ার শাসনমালেই প্রথম সৌদি আরব ও চীনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। তাঁর শাসনকালের মেয়াদ ছিল ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ থকে ৩০ মে ১৯৮১ । এই অল্প কদিনেই বাংলার মানুষের হৃদয় কেড়ে নিয়েছিলেন। তাঁর শাহাদাতের পরে মানিক মিয়া এভিনিউতে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর শাহাদতকে সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। যখনই তিনি মাত্র দেশটাকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানো শুরু করলেন, তখনই তাঁকে সুকল্পিতভাবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সততার এতটাই নজির তৈরি হয় যে, যারা তাঁকে খুব কাছে চিনতেন, তারা তাঁকে দেখে অবাক হয়ে যেতেন যে, একজন রাষ্ট্রপতি এতটা নির্লোভ কী করে হয়? তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে কোনো দুর্নীতি করার সুযোগ তিনি কখনই কাউকে দেননি। ভারতের সাথে তিনি মাথা উচুঁ করে কথা বলতে পারতেন। এমন একজন জনদরদী, সৎ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল রাষ্ট্রপতির প্রয়াণে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আজো তাঁর শূন্যতা পূরণ হয়নি। আজো তাঁর চিন্তার চেয়ে কেউ উঁচু চিন্তাধারা উপহার দিতে পারেননি। তাঁর বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদ ছিল দেশের স্থায়ী সমাধানের একটি। তাঁর অকাল মৃত্যুতে দেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। আজো থাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এটাই তাঁর জীবনের অন্যতম সফলতা। শাহাদতের এই দীনে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে।
এসএসএইচ.