শুক্রবার, ৮ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৪ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৩ সফর, ১৪৪৭ হিজরি

আসকের বিবৃতি : অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে হতাশ করেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে হতাশ করেছে বলে মন্তব্য করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বৃহস্পতিবার সংগঠনটির সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবিরের সই করা এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করে সংগঠনটি।

এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ একটি গণজাগরণের সাক্ষী হয়। চাকরিতে বিশেষ কোটা ব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন। ন্যায়, মানবিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল এই আন্দোলন। দমন-পীড়ন, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছাত্র-জনতা শাসকগোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করে রাস্তায় নেমে আসে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, দুঃখজনক হলেও সত্য, আন্দোলনের পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে হতাশ করেছে। এখনও নির্বিচারে গ্রেফতার চলছে। হেফাজতে মৃত্যু ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। যা আগের সরকারের দমনমূলক আচরণের পুনরাবৃত্তির মতোই মনে হচ্ছে।

এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে নাগরিকের নিরাপত্তা বিষয়ক উৎকণ্ঠা চলমান রয়েছে। একই সময়ে সারা দেশে উচ্ছৃঙ্খল জনতার মাধ্যমে সংঘটিত ‘মব সন্ত্রাস’র ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক প্ররোচনায় পরিচালিত কিংবা সামাজিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে সংঘটিত এসব সহিংস কর্মকাণ্ডে বহু সংখ্যক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতির আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্রমাগত দুর্বল এবং সুরক্ষাহীন অবস্থা। জনগণের প্রত্যাশা ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নিপীড়ন এবং হুমকির ঘটনা আরও বেড়েছে।

এমনকি ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালানো হয়েছে, যার মধ্যে লুটপাট এবং জীবননাশের হুমকিও রয়েছে। এসব ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনও বিচার বা শাস্তি না হওয়ায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা আরও গভীর হয়েছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গণ-আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা নারীর জন্য পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠেছে। নারীরা বর্তমানে এক বিস্তৃত নিরাপত্তাহীনতার আবহে জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশে নারীদের মারধর, অপমান এবং শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা এখন প্রায় নিয়মিত সংবাদে উঠে আসছে।

এছাড়াও সংবাদমাধ্যম আজ নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শত শত সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল, কৌশলে চাকরিচ্যুতি, মিথ্যা অভিযোগ ও মামলা, গ্রেফতার, সংবাদপত্র অফিসে হামলা এবং মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার চর্চা কতটুকু বিদ্যমান—সেই প্রশ্নটিও বছর জুড়ে অব্যাহত ছিল।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অনেক শিক্ষার্থীকে অন্যায্যভাবে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, সনদ বাতিল করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হুমকির মুখে পড়ছে।

এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মাঝে একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, বাংলাদেশ বলপূর্বক গুম থেকে রক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করেছে এবং পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে সংঘটিত গুমের অপরাধ তদন্তের জন্য একটি ‘গুম কমিশন’ গঠন করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য দায়বদ্ধতার পথে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’ পুনর্গঠন না করাটা মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বিবৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা করায় সাধুবাদ জানাচ্ছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এই সিদ্ধান্ত দেশের গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আসক আশা করে, এই ঘোষণার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। এই প্রেক্ষাপটে, আসক জোরালোভাবে দাবি করছে, আইনের শাসন, আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

বিচারহীন গ্রেফতার, মব সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, নারীর প্রতি সহিংসতায় জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ, সভাসমাবেশ ও সংগঠন করার সাংবিধানিক অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এই সংকট নিরসনে রাষ্ট্রকে এখনই কার্যকর, দায়িত্বশীল ও মানবাধিকার-বান্ধব ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তনের স্বপ্ন ব্যর্থ না হয়।