আন্তর্জাতিক ডেস্ক: নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট নেতা জোহরান মামদানি। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এই বৃহত্তম শহরের ১১১তম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন—একইসঙ্গে হয়ে উঠেছেন শহরটির প্রথম মুসলিম মেয়র। এনবিসি নিউজের পূর্বাভাসে দেখা যায়, প্রগতিশীল ভোটারদের একতাবদ্ধ করে এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে মামদানি নিশ্চিত করেছেন এই জয়।
মঙ্গলবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী মামদানি সহজ ব্যবধানে হারিয়ে দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো এবং রিপাবলিকান নেতা কার্টিস স্লিওয়াকে। কুয়োমো মূলত ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে পরাজয়ের পর স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হন। এর আগে বিদায়ী মেয়র এরিক অ্যাডামস প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে গিয়ে কুয়োমোকে সমর্থন জানান।
রাজনীতিতে প্রবেশের পর মাত্র এক বছরের মধ্যে জোহরান মামদানির এই উত্থানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। নিউইয়র্কের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের প্রতিনিধিকে তিনি টানা দু’দফায় পরাজিত করেছেন—যা শহরটির ভোটারদের মধ্যে এক নব রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত বহন করছে।
নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শুরু করে বিজয়ের পর পর্যন্ত, মামদানি জোর দিয়েছেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট মোকাবিলায়। তাঁর ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভাড়া নিয়ন্ত্রিত বাসস্থানের ভাড়া বৃদ্ধিতে স্থগিতাদেশ, বিনামূল্যে গণপরিবহন চালু, সার্বজনীন শিশুসেবা এবং সিটি করপোরেশন পরিচালিত মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা।
নির্বাচনের আগের দিন কুইন্সে হাজারো সমর্থকের সামনে মামদানি বলেন, “যেন ভাগ্য আগে থেকেই লিখে রেখেছিল এই মুহূর্ত—কিন্তু যখন প্রচারণা শুরু করি, তখন পাশে কোনো ক্যামেরা ছিল না।” তিনি যোগ করেন, “চার মাস পরেও আমাদের সমর্থনের হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ—আমরা তখনও সেই প্রার্থীর সঙ্গে সমান ছিলাম, যার নাম ছিল ‘অন্য কেউ’।’’
এনবিসি নিউজের এক্সিট পোল অনুযায়ী, মামদানি প্রায় সব জাতিগত গোষ্ঠীর ভোট পেয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো, এশীয়সহ সব জনগোষ্ঠীর মধ্যেই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। বিশেষ করে ৪৫ বছরের নিচের ভোটারদের মধ্যে তার বিপুল অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে—কুয়োমোর তুলনায় তিনি এই বয়সভিত্তিক ভোটে ৪৩ পয়েন্ট এগিয়ে ছিলেন। তবে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে ভোটারদের মধ্যে কুয়োমো ১০ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন।
শিক্ষাগত বিভাজনও নির্বাচনের ফলাফলে ভূমিকা রেখেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এছাড়া, নতুন অভিবাসী ও দীর্ঘদিনের নিউইয়র্কবাসীর ভোটাভ্যাসেও পার্থক্য দেখা গেছে।
নির্বাচনজুড়ে মামদানির মুসলিম পরিচয় ও ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান আলোচনায় ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালানো হলেও শেষ পর্যন্ত তা ভোটের ফলাফলে প্রভাব ফেলেনি। এক্সিট পোল অনুযায়ী, ইহুদি ভোটারদের মধ্যে কুয়োমো এগিয়ে ছিলেন—৬০ শতাংশ বনাম মামদানির ৩১ শতাংশ ভোট।
গত মাসে এক আবেগপূর্ণ ভাষণে মামদানি বলেন, “তারা চেয়েছিল এই নির্বাচনকে আমার ধর্মবিশ্বাসের ওপর গণভোটে পরিণত করতে। কিন্তু আমি লড়েছি নিউইয়র্কবাসীর জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটের বিরুদ্ধে।”
মামদানির জয়কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নতুন রাজনৈতিক আলোচনার জন্ম হয়েছে। প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থকরা একে “নতুন অধ্যায়ের সূচনা” হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান নেতারা এই ফলাফলের সমালোচনা করেছেন। ট্রাম্প এমনকি নির্বাচনের আগের রাতেই কুয়োমোকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, “স্লিওয়াকে ভোট দেওয়া মানেই মামদানিকে ভোট দেওয়া।”
অন্যদিকে এক্সিট পোল দেখায়, রিপাবলিকান ভোটারদের বড় অংশ শেষ পর্যন্ত কুয়োমোকেই সমর্থন করেছেন—রিপাবলিকানদের ৬১% ভোট গেছে তার পক্ষে, যেখানে নিজ দলের প্রার্থী স্লিওয়া পেয়েছেন ৩৫% ভোট।
নিউইয়র্কের নতুন মেয়র হিসেবে এখন মামদানির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিশাল প্রশাসনিক কাঠামোকে পরিচালনা করা এবং অ্যালবানি ও সিটি কাউন্সিলের নেতাদের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় তৈরি করা। জাতীয় রাজনীতিতেও তার উত্থান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জন্য এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মামদানি যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বার্তা ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছেছেন, তা ভবিষ্যতের মার্কিন রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
মুসলিম হিসেবে তার এই বিজয় শুধু নিউইয়র্ক নয়, বরং সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রগতিশীল রাজনীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল—যেখানে ধর্ম, জাতি ও পরিচয়ের সীমা অতিক্রম করে ভোটাররা বেছে নিয়েছেন নতুন প্রজন্মের এক সাহসী নেতৃত্বকে।