শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

ইরান-ঈসরায়েল সংঘাতের ফলাফল কোন পথে?

মেহেদী হাসান পলাশ

মেহেদী হাসান পলাশ :

ইরান মোটামুটি কথা রাখতে পেরেছে। গতরাতে প্রথম আঘাতে হাইফা বন্দর নগরীর মিজাইল আঘাতের পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা জানা না গেলেও যে পরিমাণে আঘাত হেনেছে তাতে এই নগরী সহজে উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলা ও বন্দর যেরকম, ইসরাইলের ক্ষেত্রে হাইফা নগরীর ও বন্দরের গুরুত্ব একই রকম। ইসরাইলের তেল পরিশোধনের ৬০% এখানে হয়ে থাকে। তাতে ইরান সফলভাবে হামলা করেছে। ইসরাইলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এই বন্দর দিয়ে সম্পাদিত হয়। তাতেও ইরান সফলভাবে হামলা করেছে। মোটকথা ইসরাইলী হার্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ আর্টারি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষকে খুব খুশি হতে দেখলাম এ কারণে যে, হাইফা বন্দরের ৭০% মালিকানা ভারতীয় আদানি গ্রুপের। ইরানে আটক সন্দেহভাজন মোসাদ এজেন্টদের মধ্যে ৭৩ জন ভারতীয় হওয়ার পরে ইরান একটি শিক্ষা দিতে চেয়ে থাকতে পারে। চাবাহার বন্দর ভারতের হাতে তুলে দেয়ার একটি উচিত শিক্ষা ইরান নিজেও পেয়েছে।

ভোররাতে ইরান তেলআবিবে ভয়াবহ হামলা করেছে যা আগের দিনের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এই হামলায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানীর ঘটনাও বেশি ঘটেছে। রাজধানীবাসির ভেতরে এই হামলা এতটাই আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে, অনেকে কাপড় পড়ার সময় পায়নি। তার আগেই পালাতে হয়েছে।

ইসরাইলের হামলায় ইরানি জেনারেল, পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস সেক্টর এবং পরমাণু স্থাপনা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ইরান এখন পর্যন্ত ইজরাইলি পরমাণু স্থাপনায় সেভাবে আঘাত হানেনি। ইরানের কাছে প্রমাণিত পরমাণু বোমা থাকলে আজকে হয়তো ইরানকে এই ভয় পেতে হত না। তারাও পাল্টা জবাব দিতে পারতো। হতে পারে এ ব্যাপারে ইসরাইলি কোন সিগন্যাল ইরানের মাথায় রয়েছে।

প্রথম কয়েক ঘন্টার যুদ্ধে ইসরাইল ইরানের যে ক্ষয়ক্ষতি করেছে, কেবলমাত্র জেনারেলদের হারানো ছাড়া ইরান মোটামুটি ইসরাইলের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে গত রাতের পর। যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে দুই পক্ষই একটা লক সিচুয়েশনে পড়েছে। ইসরাইল এখান থেকে সরে যেতে পারবে না সহজে। কেননা তাতে নেতানিয়াহু সরকারের পতন ঘটবে। তাছাড়া বিশ্বের কাছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক শক্তির যে মিথ রয়েছে, তা অনেকখানি ভেঙ্গে গেছে। সুস্পষ্ট বিজয় ছাড়া তার পক্ষে ফিরে আসা খুব সহজ নয়।

কিন্তু ইসরাইলের পক্ষে এই যুদ্ধে সুস্পষ্ট বিজয় লাভ অনেকটাই অসম্ভব, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া। কেননা এ ধরণের অপারমাণবিক যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ইসরাইল নিশ্চিতভাবে হারবে। এর প্রধান কারণ ইজরাইল রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা। গত দুই দিনে ইজরাইলের যে ক্ষতি হয়েছে, এরকম কয়েকগুণ ক্ষতি সাইজের কারণে ইরান হজম করতে পারবে। এমনকি দাঁতে দাঁত চেপে এক/আধখানা পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণও চাইলে সহ্য করে নিতে পারবে। ৪-৫ লাখ ইরানি হাসিমুখে শাহাদাত বরণ করে নিতে পারবে নির্দ্বিধায়। প্রয়োজনে সারা বিশ্ব থেকে আরো ১-২ কোটি শিয়া মুসলিম বা সুন্নি মুসলিম শাহাদাতের তামান্না নিয়ে ইরানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ইসরাইল ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা পেলেও একজন ইহুদীও সেখানে মরতে যাবে না।

ইসরাইল ২০ হাজার জনগণ হারানোর ক্ষতি সহ্য করতে পারবেনা। গত অর্ধশতাব্দী ধরে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে শুধু মেরে এসেছে। কোটি কোটি মুসলিম মেরেছে। তবুও মুসলিমরা শেষ হয়ে যায়নি, টিকে আছে এবং তাদের ইন্তিফাদাও শেষ হয়নি। কিন্তু ওরা মরতে শেখেনি। ওদের কাছে ১০০০ মানুষের মৃত্যুও অনেক। ইরান যদি শ তিনেক ব্যালেস্টিক বা হাইপারসনিক মিজাইল ইসরাইলে সুনির্দিষ্ট টার্গেটে আঘাত হানতে পারে, সেই ক্ষতি তারা ধারণ করতে পারবে না। এটা লুকাতেও পারবেনা। পুরো দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। বাইরে থেকে সমর্থন যা ই দিক, পশ্চিমারা এই ইহুদিদের জায়গা দেবে না স্বদেশে। এদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই একমাত্র রাশিয়া ছাড়া। সে কারণে ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়ার পেছনে সর্বতোভাবে দাঁড়ালেও, রাশিয়া এখন পর্যন্ত ইরানকে লিপ সার্ভিস ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।

সেক্ষেত্রে ইসরাইলের সামনে দুইটি রাস্তা রয়েছে-
১. এক পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার।
এক্ষেত্রে আমেরিকার অনুমতি ছাড়া ইসরাইল এই অস্ত্র আদৌ ব্যবহার করতে পারবে কিনা এবং আমেরিকা সেই অনুমতি দেবে কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কেননা আধুনিক বিশ্বে আরো একবার পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ফিরিয়ে আনা এবং এর বিপুল ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতির দায় আমেরিকা তার নিজের ঘাড়ে নেবে কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

দ্বিতীয় অপশন, যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের সরাসরি অংশগ্রহণ। এ পথে ইসরাইল এই যুদ্ধে জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে আরব- ইসরাইল যুদ্ধের মত। কিন্তু এই কাজটি খুব সহজ নয়। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে তারা এই যুদ্ধে ইজরাইলের প্রতিরক্ষায় অংশ নিয়েছে, কিন্তু ইজরাইলের পক্ষ হয়ে হামলায় অংশ নেয়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ধারণা ইসরাইলকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স।

অন্যদিকে ইসরাইলের পক্ষে থাকা আরব রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের আকাশসীমা লংঘন করে যাওয়া ইরানি মিজাইল ও ড্রোন ভূপাতিত করার অনুমতি দিলেও সেখান থেকে ইরানের উপরে হামলা চালানোর অনুমতি দেয়নি। কেননা ওই সব দেশ থেকে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালায়, তখন ইরান তার প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে ওই সকল দেশে হামলা চালানোর ন্যায্যতা পেয়ে যাবে। ফলে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার ক্ষয়ক্ষতি মূলত তাদেরকে বহন করতে হবে। এখন পর্যন্ত ইরানি মিসাইলের যে কারিশমা তারা দেখেছে তাতে আমার মনে হয় না এই সকল আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের দেশ থেকে ইরানে হামলা করার অনুমতি দেবে।

তাছাড়া এই যুদ্ধে যদি আমেরিকা ও ব্রিটেন সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ে তাহলে শিয়া প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে রাহাবারের একটি ফতোয়ায় কোটি কোটি শিয়া মুসলিম মানব বোমায় পরিণত হবে। এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে আক্রমণকারী দেশসমূহের অবস্থানে আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে।

ইরানের প্রধান দুর্বলতা আক্রমণ চালানোর যোগ্য যুদ্ধ বিমানের অনুপস্থিতি। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান দীর্ঘদিন যুদ্ধবিমান ক্রয় করতে পারেনি বহির্বিশ্ব থেকে। এটাই আবার ইসরাইলের প্রধান শক্তি। তাদের হাতে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক মার্কিনী যুদ্ধবিমানগুলো। এগুলোর মধ্যে এফ-১৫ এফ-১৬ এবং বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী বিমান এফ ৩৫। কেবল ইসরাইল নয় বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই যুদ্ধবিমানগুলো। এছাড়াও মার্কিন যুদ্ধ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এগুলো। ইরান দাবি করেছে ইতোমধ্যেই তারা ১০ টির বেশি ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ভূপতিত করেছে। বলা ভালো মার্কিনী যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ইরান যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে তাহলে খুব বেশি দূরে নয় যে, আমেরিকা তাদের যুদ্ধবিমান এই লড়াইয়ে অংশ নিতে ইরানের আকাশে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। কেননা এই যুদ্ধবিমানগুলো যেমন মার্কিনী অহংকার ও শক্তির প্রতীক, তেমনি মার্কিনী যুদ্ধ অর্থনীতিরও মূল চালিকা। সম্প্রতি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানী চাইনিজ বিমানের হাতে ফরাসি রাফাল বিমান ভূপাতিত হওয়ার পর যেভাবে রাফাল কোম্পানির শেয়ার মার্কেট পড়েছে এবং চেংদু কোম্পানির শেয়ার মার্কেট উল্লম্ফন ঘটেছে এবং বিশ্বের দেশে দেশে রাফালের অর্ডার রিভিউ করা হয়েছে, সেই দৃষ্টান্ত নগদ দৃষ্টান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভোলার কথা নয়। তবে গত কয়েক দিনের আঘাতে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা সংহত আছে সেটাও এখানে বিবেচ্য বিষয়।

অন্যদিকে ট্রামকার্ড হিসেবে ইরান এখনো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করেনি। এছাড়াও ইরানের যে নৌ শক্তি রয়েছে, মিজাইল, নেভি ড্রোন রয়েছে তাতে ইরানের কাছাকাছি অবস্থান করে মার্কিন ও ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ থেকে আক্রমণ করে টিকে থাকা খুব সহজ হবে না তাদের পক্ষে। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি হুতি মিজাইলের আঘাতে মার্কিন ফ্লিট গুলোর পশ্চাদপসারণের দৃষ্টান্ত বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। এই ফ্লিটগুলো দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে পশ্চিমারা ইরাকের মত শক্তিশালী রাষ্ট্র ধ্বংস করে দিতে পারলেও খুব ক্ষুদ্র আকারের হুতিদের কাছে নাজেহাল হওয়া ঘটনা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে পশ্চিমারা এই যুদ্ধে কতটা সরাসরি অংশ নেবে তা সংশয়াতীত নয়।

সাদ্দাম হোসেনের পরাজয়ের মূল কারণ ইরাকি শিয়া সামরিক কর্মকর্তাদের বিশ্বাসঘাতকতা। এই একটা বিষয় এখানেও পরিণতি এনে দিতে পারে। ইরানের ভেতরে বিপুল পরিমাণে ইসরাইলি এজেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে একটিভ রয়েছে। এটা মোসাদ বহুবার প্রমাণ দিয়েছে। এই একটি শক্তি কেবলমাত্র ইসরাইলকে জয় এনে দিতে পারে।

জেড/এইচ/৫৪-২৫