শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

একটি নেটফ্লিক্স সিরিজ ও আধুনিক যুগের বাচ্চা পালন

সৈয়দা নূরাহ বিনতে শামস

ধরুন খুব সকালে আপনার ঘুম ভাংলো ঘরে পুলিশের অতর্কিত অনুপ্রবেশে। নিজেকে সামলে কিছু বুঝে উঠার আগেই পুলিশ জানালো তারা এসেছে আপনার ১৩ বছরের ছেলেকে আরেস্ট করার জন্য। তারই সহপাঠীকে খুন করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হবে। এমতাবস্থায় আপনি কি করবেন? আপনার সদ্য কৈশোরে পা দেয়া ছেলে খুনি, এই তথ্য হজম করবেন? নাকি পাশে চিৎকাররত স্ত্রীকে সামাল দিবেন? বিষয়টি নিঃসন্দেহে যেকোনো ছেলে-মেয়ের বাবামায়ের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো।

নেটফ্লিক্স-এ বয়ঃসন্ধিকাল বিষয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলির সবচেয়ে আলোচিত টিভি সিরিজগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে “Adolescence”। যা বিশ্বজুড়ে, অনলাইনে, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে৷

পশ্চিমা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়া মাত্র চার পর্বের এই সিরিজটি যেকোনো টিনএজের বাবা মায়ের জন্য একটা সতর্কবার্তা। ক্ষনিকের জন্য মনে হতে পারে এটা একটা সিরিজ মাত্র, কিন্তু এটি নিছক কোনো গল্প নয়। ডিরেক্টর স্টিফেন গ্রাহামের মাথায় এই সিরিজ টি বানানোর চিন্তা আসে ২০২১ সালে একটা মর্মান্তিক ঘটনার মুখোমুখি হবার পর। লিভারপুলে তার নিজ বাসস্থানে ১২ বছর বয়সী আ্যভা হোয়াইট কে ১৪ বছর বয়সী এক ছেলে উপর্যপরি ছুরিকাঘাতে খুন করে।

২০২৩ সালে ১৫ বছর বয়সী আ্যলিয়ানকে একটি শপিংমলে কিচেন নাইফ দিয়ে আক্রমণ করে হাসান সেন্তামু নামে ১৭ বছর বয়সী এক ছেলে।

খুব সম্প্রতি আমাদের দেশে লাইভে এসে মেয়ে কর্তৃক বাবার খুন করার ঘটনাটি নিশ্চয়ই স্মরণে থাকার কথা। এছাড়াও নানান সহিংস ও মর্মান্তিক ঘটনা ফেসবুক খুললেই দেখতে পাই যার ৯০% ঘটাচ্ছে কিশোররা।

এই ঘটনাগুলো আমাদের কঠিনভাবে এক বাস্তবতার সামনে দাড় করিয়ে দেয়, যার জন্য আমরা কোনোভাবেই প্রস্তুত নই। এটা এমন এক সত্য যাকে হজম করাও সম্ভব নয় আবার বিছিন্ন ঘটনা বলে উগড়ে ফেলাও যায় না।

কারণ প্রতিনিয়তই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এধরনের খবর শোনা যায়। স্টিফেন গ্রাহামের মতো আমাদের ও ভাবতে হয় কি হচ্ছে আমাদের সাথে? কি হয়েছে আমাদের সমাজটার? কিভাবে আমরা এই পর্যায়ে নেমে এসেছি?  কিশোর-কিশোরী যাদের সমাজে আদতে নিরীহ সদস্য হিসেবেই নেয়া হয় তাদের মানসিক কি এমন পরিবর্তন ঘটে বয়ঃসন্ধিকালের এই সময়টাতে যেটা তাদেরকে ভয়ঙ্কর ভাবে বদলে দেয়, তাদের এমন সহিংস আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

আমরা আমাদের সন্তানকে আসলে কতটা জানি? কতুটুকু চিনি তার জগৎ?

বাবা মায়েরা তার সন্তানকে জানেন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। যতদিন তার খাবার সময়ে আপনাকে প্রয়োজন হয়। যতদিন পর্যন্ত সে আপনার গায়ের সাথে গা না লাগিয়ে ঘুমুতে পারে না। যখন সে রাতে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলে আপনি জরিয়ে ধরে তাকে সান্তনা দেন। তার ভুবন জুড়ে শুধুই আপনি থাকেন। এরপর সেও বড় হতে থাকে আর আপনার প্রয়োজন ফুরোতে থাকে ধীরে ধীরেই। আপনার মনে ছাপ রয়ে যায় একটা ছোট্ট শিশুর যে আপনার গায়ের গন্ধ ছাড়া ঘুমোতে যেত না। অতঃপর একদিন আপনি আবিষ্কার করেন সেই ছোট্ট ছেলে অথবা মেয়েটি আপনার তার ফোন ধরা পছন্দ করছে না, আপনি তার রুমে গেলে অস্বস্তি প্রকাশ করছে। খুব কম বাবা মায়েরাই বয়ঃসন্ধিকালের এই জটিল সময়টাতে সন্তানের পাশে থাকতে পারেন, মিশতে পারেন। বাকিরা একটা দুরত্বের বেড়াজালে আটকা পড়েন যা আর কখনোই কাটানো সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বর্তমান জেনারেশন-জি (১৯৯৭-২০১২) আর জেন- আলফা (২০১০-) এর চিন্তা ভাবনা আমাদের আগের যেকোনো জেনারেশন থেকে কয়েকগুণ বেশি অগ্রসর। এরা কে-পপ দেখে বড় হয়, হলিউডের সেরা সেরা মুভি নিয়ে আলোচনা করে। চ্যাট-জিপিটি আর এ-আই দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে।

“Adolescence” এর জেইমি খুব সাধারণ পরিবারের একটা ছেলে। তার বাবা ‘এডি’ মোটামুটি ধরনের একজন কর্মজীবী মানুষ। মা একজন গৃহিণী। সাধারণত পশ্চিম দেশগুলোতে ছেলেমেয়েদের বখে যাওয়ার কারণ হিসেবে থাকে বাবা মায়ের মনোযোগের অভাব, পরকিয়া, মদ্যপানের অভ্যাস, মারধোরের মতো আচরণ। জেইমির পরিবারে এধরনের দৃশ্যত অত্যাচার ছিলো না। তবুও কেন তাদের ছেলে একজন খুনি হয়ে উঠলো?

এর বেশ কিছু উত্তর খুজে পাই। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণগুলো হচ্ছে জেইমির আত্মসম্মানের অভাব, স্কুলে বুলিং এর শিকার হওয়া, এবং অনলাইনে ইনসেল প্রোপাগান্ডার প্রভাব।

“ইনসেল” শব্দটি একটু নতুন শোনাতে পারে অনেকর কাছে, কিন্তু এর প্রভাব ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে কিশোরদের মধ্যে। সাধারণ অর্থে এর বিষয়বস্তু হচ্ছে নারীদের প্রতি কিছুটা তুচ্ছ মনোভাব রাখা একইসাথে ছেলেদের নিজেকে অন্যদের তুলনায় সেরা প্রমাণ করার প্রবণতা। একসময় এটা ইন্টারনেট স্ল্যাং-এর একটি বিশেষ অংশ ছিল যেটা এখনও কিছু ক্ষেত্রে গালি হিসেবে বা কাউকে ছোট করতে ব্যবহৃত হয়।সিরিজে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর সাথে জেইমির কথোপকথনের একটি দৃশ্য আছে। দৃশ্যটি না দেখলে আপনি কখনোই বুঝবেন না একজন বাচ্চা ছেলে কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে পুর্ণবয়স্ক মানুষের মধ্যে। যখন সে জিজ্ঞেস করে, ‘Did I scare you? সাধারন একটা বাক্য, আপনি নিজেও হয়তো চমকে যাবেন বাচ্চা একটা ছেলেকে ভয় পাওয়ার কি আছে। কিন্তু একই সাথে তার চেহারায় ফুটে উঠে আধিপত্য এবং উপহাসের অসাধারণ ভারসাম্যপূর্ণ প্রদর্শন আপনাকে স্তম্ভিত করে দেবে।

বয়ঃসন্ধির সময়টাতে সবাই একজন আইডল ফিগার খুঁজে বেড়ায়। এই সময়ে একজন ছেলে অথবা মেয়ে থাকে খুবই অপরিপক্ক  এবং নরম মাটির দলার মত। সে তার চারপাশে থাকা যেকোনো মানুষকে নিজের অজান্তেই অনুসরণ করতে থাকে, আশেপাশের মানুষ না হলে অনলাইন কোনো ব্যাক্তিত্ব খুজে নেয়। এবং যাকে সে তার আর্দশ বলে গ্রহণ করে তার কাছ থেকে মনোযোগ,  দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। একই জিনিসটা আমরা দেখছি জেইমির ক্ষেত্রেও। সিরিজের সর্বত্র তার মাঝে বাবাকে অনুসরণ করার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। সে জানে সে তার বাবার মতো খেলাতে পারদর্শী নয়, তবুও সে চেষ্টা করে বাবার মন জয় করতে। এতে ব্যর্থ হলে সে নিজের কাছে আর বেশি ছোট অনুভব করে। কারণ, সে তার বাবার প্রত্যাশা পুরন করতে পারছে না। আমাদের ছেলে মেয়েরা যে আমাদের মনের মতোই হবে এটা আশা করা ও চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। সে যেমনি হোক না কেন সংবেদনশীল অথবা দুরন্তপনায় ভরপুর বাবা মায়ের এটা নিশ্চিত করা উচিত যেন সে নিজেকে সমাজের বাইরের কেও মনে না করে। তাকে যেন এই অনুভূতি না দেয়া হয় তুমি অন্যের মতো চটপটে হতে পারছো না কেউ তোমাকে এভাবে গ্রহণ করবে না। বরং তাকে আতœবিশ্বাসী করে তোলা উচিত যে তুমি যেমনটি হোও না কেন একজন ভালো মানুষ হিসেবে সবর্দা মুল্যবান।

সিরিজটি শেষের দিকে একজন পিতা হিসেবে জেইমির বাবা মায়ের অসহায়ত্ব আপনাকে নাড়া দিবে। জেইমির বাবা অসহায় ভাবে নিজেকেই প্রশ্ন করে, আমরা আসলে কোথায় ভুল করেছি। এর জন্য তো আমরাই দায়ী। আমরা তার খেয়াল রাখতে পারিনি। সে প্রতিদিন স্কুল থেকে এসেই রুমে ঢুকে যেত আমরা ভেবে নিয়েছিলাম ঘরেই তো আছে, নিরাপদে আছে। কম্পিউটারে গেমস খেলছে হয়তো।

আমাদের ছেলে মেয়েরা ইন্টারনেটে আসলে কি দেখে তার খোঁজ কয়জন বাবা মায়েরা রাখি? ইন্টারনেট জিনিসটা সাগরের চেয়েও বিশাল। তারা এখানে এতো বেশি তথ্য পায় আর গ্রহণ করে যা চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

এবং অনলাইন বাচ্চাদের এমন কিছু যুক্তি শেখায় যা আসলে সঠিক না ভুল তা বিচার করার মতো মানসিকতা তখনও তাদের তৈরি হয়নি। তারা বিশ্বকে খুব কুৎসিত বা বিকৃত উপায়ে আবিষ্কার করে আর সত্যি বলতে পৃথিবীটা কখনোই খুব সুন্দর জায়গা ছিলো না। ইন্টারনেটের মাধ্যামে বাচ্চারা এই কঠিন সত্যটা দ্রুতই আবিষ্কার করে ফেলে।

বাচ্চাদের এই ভয়াবহ দুনিয়া থেকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র দুটি উপায়ে আপনার সন্তানকে এই ভয়াবহতা থেকে দুরে রাখতে পারবেন। এক. সকল প্রকার ডিভাইস থেকে তাকে দুরে রাখা যা আদতে এক প্রকার অসম্ভব ই বলা যায়, দ্বিতীয়ত তাকে নীতি-নৈতিকতার সাথে নিজের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে পরিচয় করানো, সহজ ও স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মভীতি আছে। বেশিরভাগই ধর্মকে এড়িয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন আর যারা পালন করেন তারা এতোটাই কঠোরতার সাথে নিয়মের বাইরে যাওয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন যে যারা প্র্যাকটিসিং মুসলিম নন তারা শিখতেও বিব্রতবোধ করেন। ফলাফল ১১-১৮  বছর বয়সীদের ধর্মের প্রতি বিরুপ মনোভাব। তারা ব্যস্ত থাকে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের অতি আর্কষণীয় দুনিয়ায়।

এই সিরিজটি সহিংসতামূলক আচরণের কোনো সমাধান দেয় না। শুধুমাত্র সবাইকে একটি বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সামাজিক সমস্যাটি যেটা ভয়ানক আকার ধারণ করছে দিনে দিনে সেই সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য যারা সমাজের দ্বায়িত্বশীল লোক হিসেবে আছেন তারা যেন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিশেষত শিক্ষা কার্যক্রম এর সাথে যুক্ত ব্যাক্তিদের এ বিষয়ে আরো নজর দেয়া উচিত। স্কুলে সুস্থ বিনোদন ও পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। শিক্ষকদের আরো দায়িত্বশীলতা ও যতেœর সাথে স্কুলের সময়টাতে ছাত্রদের পরিচালনা করা দরকার। সেইসাথে বাবা-মায়েদের ও সন্তানের প্রতি আরো মনোযোগী হতে হবে। তারা কি দেখছে, স্কুলে কি শিখছে, কার সাথে মিশছে, কাকে অনুসরণ করছে এবং সেগুলো তার জন্য মঙ্গলজনক কিনা সেটা জানা থাকা দরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ সম্পর্কে কথা না বলছি, এড়িয়ে চলছি পরিস্থিতি আরও খারাপ হতেই চলেছে।

অন্তত আমাদের এই বিষয় নিয়ে সচেতন থাকা এবং এই বাচ্চাদের কাছে পৌঁছানোর উপায় বের করার চেষ্টা করা দরকার।