শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

এমন ঈমানই মুমিন জীবনের কাম্য

সৈয়দ শামছুল হুদা

হজের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। সারা দুনিয়া থেকে মানুষ মক্কায় যাচ্ছেন। প্রতিটি মীকাত থেকে শুধু একটাই ধ্বনি, আর সেটা হলো: লাব্বাইক আল্লাহুম্ম লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা, ওয়ান-নিয়ামাতা, লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক’ হে আল্লাহ, আমি আপনার বান্দা হাজির, নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা এবং নিয়ামতারাজি আপনার, আপনারই রাজত্ব, আপনার কোনো অংশদীদার নেই। মক্কার অলিতে-গলিতে এখন শুধুই এই শ্লোগান। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজী সাহেবানরা আসছেন। মক্কার ঘরের মেহমানরা  আসছেন। এই আসা-যাওয়ার পথে প্রতি বছরই আল্লাহর বান্দারা অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে যান। এ বছর ১৪৪৬ হিজরী সনের হজের যাত্রা পথে এমনই এক চমকদার ঘটনা ঘটে গেলো সম্প্রতি, যার সারা দুনিয়ার মানুষকে নাড়া নিয়েছে। মানুষের ঈমান যদি মহান আল্লাহর প্রতি সুদৃঢ় হয়, তাহলে কীভাবে যে, আল্লাহ সাহায্য করেন, তা কেউ কল্পনা করতে পারে না। এমনই এক হৃদয়গ্রাহি ঘটনা ঘটলো লিবিয়ার এক যুবকের সাথে।

যুবকের নাম আমের আল মাহদি মাসুর আল গাদ্দাফি। তিনি এ বছর পবিত্র হজ পালনের মনস্থির করেন। সে মোতাবেক তিনি প্রস্তুতিও নেন। হজের সফরে বের হয়ে পড়েন। বিমানবন্দরে আসেন বিমানে আরোহণের জন্য। আর তখনই ঘটে সেই মজাদার ঘটনা। তিনি যে বিমানের যাত্রী, সে বিমানের সব যাত্রী বিমানে উঠে পড়েন। কিন্তু উনাকে ইমিগ্রেশনে আটকে দেওয়া হয়। প্রথমে তিনি বুঝতেই পারেননি কী কারণে তাকে আটকে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তাকে রেখেই বিমান মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। পড়ে জানা যায়, তার নামের শেষে গাদ্দাফি শব্দ থাকায় তাকে আটকে দেওয়া হয়েছে। লিবিয়ার সাবেক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির সাথে নামের মিল হওয়ার কারণে ইমিগ্রেশনের পুলিশ আটকে দেয় এই কারণে যে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলমান। সেখানে বিমানে আরোহণের ক্ষেত্রে এই নামকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। অনেক আকুতি-কাকুতি করার পরেও ফ্ল্যাইট ক্যাপ্টেন তাকে ছাড়াই যাত্রা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা এবং সময়সূচির সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি তাকে ছাড়াই বিমান ছেড়ে দেন।

কিন্তু আমের ছিলেন অনড়। তিনি পবিত্র মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। গালফ নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় এবং বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন। ফিরে এসে ছোটখাট মেরামতের পর আবারও বিমান তাকে ছাড়াই আকাশে উড্ডয়ন করে। আকাশে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর আবারও একই ঘটনা ঘটে। বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এবং বিমানটি আবার রানওয়েতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এবার যাত্রী ও ক্রুদের চোখ খুলে। দ্বিতীয়বার জরুরি অবতরণের পর এবার ক্যাপ্টেন নিজ থেকেই ঘোষণা করেন, আমি শপথ করছি, আমের আমাদের সাথে এই বিমানে না থাকলে আমি আর ফ্লাইট চালু করবো না। কর্তৃপক্ষ দ্রুত আমেরকে তার ভ্রমণের অনুমতি দেয়। তৃতীয় প্রচেষ্টায়  আমেরকে নিয়েই বিমানটি কোনোপ্রকার দুর্ঘটনা বা ঝামেলা ছাড়াই যাত্রা করে এবং নিরাপদে সৌদি আরবে পৌঁছুয়। এ অবিশ্বাস্য ঘটনা দ্রুতই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এটাকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি অলৌকিক ঘটনা হিসেবে মূল্যায়ন করেন। এটা তাঁর বিশুদ্ধ নিয়তের প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করেন। আমের পরবর্তীতে স্থানীয় গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি শুধু হজ করতে চেয়েছিলাম। আর আমি বিশ্বাস করতাম, যদি এটা আমার ভাগ্যে লেখা থাকে, তবে কোনো শক্তিই  তা আটকাতে পারবে না। অবিশ্বাস্য তাঁর ঈমান। অনেক উঁচু ছিল তাঁর ইখলাস। আর আল্লাহ তাআলা সে জন্যই এই আধুনিক যুগে এসেও এক নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়ে দেখালেন যে, মানুষ যদি প্রকৃত আল্লাহকে রাজি-খুশি করানোর উদ্দেশ্যে কোনো কাজের নিয়ত করে, তাহলে তিনি অলৌকিকভাবেও সেটা বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারেন। আমের এই ঘটনা সত্যিই সকল সন্দেহ প্রবণ মানুষের চোখ খুলে দিবে।

মুমিনের ভরসা থাকবে মহান আল্লাহর ওপর। কোনো আসবাবপত্রের ওপর বিশ্বাস থাকলে জীবনে সফল হওয়া যাবে না। কত কপালপোড়া এমনও আছে যে, সে হজ্জের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরও সে হজ করতে পারে নাই। পবিত্র মক্কায় হাজিরা দিয়েও সে আরাফাহতে পৌঁছতে পারে নাই। হজ একটি অতি পবিত্র বরকতময় ইবাদত। আমাদের সকলের উচিত আমাদের নিয়ত বিশুদ্ধ করা। সকল কাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য যেন হয় একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। তাহলে আল্লাহ তায়ালা বান্দার ইচ্ছাকে অলৌকিকভাবেই পূরণ করে দিতে পারেন। যুগে যুগেই এমন ঘটনা ঈমানদারদের জীবনে ঘটেছে। আমের সর্বশেষ নতুন সংযোজন। আমের আল মাহদি আমাদের ঈমানের পথে প্রেরণা হয়ে থাকুক। এ বছরের সকল হাজীদের মহান আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। হজ্জ শেষে নিরাপদে সকল হাজীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার তৌফিক দান করুন।

আমের আল মাহদি সম্পর্কে মক্কার ইমাম ইয়াসির আদ দুয়াইসির এক স্টেটাসে লিখেন, যে ব্যক্তি লিবিয়ার এই নেককার বান্দার সাথে সাক্ষাত হবে, সে যেন তার নিকট থেকে নিজের জন্য দুআ প্রার্থনা করে। তার ঈমান এতই শক্তিশালী ছিল যে, যতবারই তাকে ছাড়া বিমান উড়ে যাচ্ছিল, তত বারই সে বলছিল, আমি হজ্জ করতে এসেছি, আমাকে ছাড়া এই বিমান উড়তে পারে না।’ তাঁর এই ঈমানী দৃঢ়তা আমাদেরকে নতুন করে ঈমান শিক্ষা দিয়ে গেল। হাজী সাহেবগণ নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরে থাকেন। তাঁদের নিকট থেকেই এমনিতেই দুআ গ্রহণের রীতি ইসলামে প্রচলিত। বিশেষভাবে কিছু হাজী থাকেন যাদের হজ্জ কবুল হয়ে গেছে এমন আশা করা যায়। সকল হাজীদের হজ্জই মহান আল্লাহর কাছে কবুল হয় আমরা এই বিশ্বাস করি। যাকে মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র ঘরে যাওয়ার তৌফিক দিয়েছেন, নিশ্চয়ই সেটা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণেই হয়ে থাকে। তারপরও কিছু হাজী সাহেবের আমল এমন হয়ে থাকে, মহান আল্লাহ যেন তাঁদের আমলে একেবারেই সন্তুষ্ট। আল্লাহ  তআলা আমাদের সকলকে এমন হজ্জে মাবরুর সম্পাদন করার তৌফিক দান করুন।