দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘ডামি ও প্রহসনের’ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের ভয়াবহতা আগে জানলে তিনি দায়িত্বই গ্রহণ করতেন না। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে রিমান্ড শুনানিতে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
রাষ্ট্রদ্রোহ, অনিয়ম, প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনে কারচুপি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ডিবি পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে। শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শামসুজ্জোহা সরকার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী শুনানিতে বলেন, হাবিবুল আউয়াল ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার অধীনে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ‘কলঙ্কজনক’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আওয়ামী লীগ ও কয়েকটি দল ব্যতীত কেউ অংশ নেয়নি। পিপির ভাষায়, “সেই নির্বাচন ছিল একতরফা, লোক দেখানো এবং প্রহসনের।”
তিনি অভিযোগ করেন, “৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, সারাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে। ওইদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে তিনি জানান। তার এক ঘণ্টা পর ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান। অথচ আমরা দেখেছি কেন্দ্রগুলোতে কোনো মানুষ ছিল না। কুকুর-বিড়াল কেন্দ্রে শুয়ে আছে। ওই এক ঘণ্টা তিনি কোথায় ছিলেন, জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে জানান, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কতটা হাস্যকর কথাবার্তা” বলেন ফারুকী।
তিনি আরও বলেন, আসামির বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে আঁতাত, সংবিধান-বহির্ভূত বক্তব্য, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতসহ রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতেই সর্বোচ্চ রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে আসামিপক্ষে আইনজীবী এমিল হাসান রুমেল বলেন, “তার বয়স ৭০ বছর এবং তিনি বহু জটিল রোগে আক্রান্ত। আমরা যেন ফ্যাসিস্ট দমন করতে গিয়ে নিজেরাই ফ্যাসিস্ট না হয়ে যাই।”
শুনানির এক পর্যায়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে বক্তব্য দেন সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, “প্রসিকিউশনের বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। নির্বাচনটি ডামি ও প্রহসনের ছিল। আমি বলেছিলাম, কেউ নির্বাচনে না এলে আমি কি বসে থাকব? নির্বাচনের বাস্তবতা ছিল ভয়ংকর। আগে জানলে দায়িত্বই নিতাম না।”
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের তুলনায় দলীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচনই বিতর্কিত। মৌলিক সংস্কার ছাড়া এক হাজার বছরেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।”
আদালত থেকে প্রশ্ন আসে, নির্বাচনী ইনকোয়ারি কমিটির ভাতা ২২ হাজার টাকা থেকে পাঁচ লাখে উন্নীত করার মাধ্যমে জনগণের অর্থ অপচয় করা হয়নি কি না। জবাবে আউয়াল বলেন, “সম্ভবত পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় তা করা হয়েছিল।” বিচারক আরও প্রশ্ন করেন, ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যরা কি সরেজমিন পরিদর্শন করেছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাই বাস্তব কাজ করেন, কমিশনের হাতে সবকিছু থাকে না।
বিচারক প্রশ্ন করেন, “অবস্থা বুঝে আপনি পদত্যাগ করলেন না কেন?” উত্তরে হাবিবুল বলেন, “পদত্যাগ করা তখন সম্ভব ছিল না। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, পদত্যাগ করো। আমি বলেছিলাম, জানলে দায়িত্ব নিতাম না।”
তিনি আরও বলেন, “১৯৭৩ সালের নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। শেখ মুজিব ক্ষমতার লোভ সামলাতে পারেননি। আওয়ামী লীগ একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে, পরে তারাই সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়েছে।”
এ সময় পিপি ফারুকী উত্তেজিত হয়ে বলেন, “আসামি নিজেকে জাস্টিফাই করছেন, তার এমন বক্তব্য দেওয়ার অধিকার নেই।” উত্তরে আউয়াল বলেন, “জাস্টিফাই করতে না দিলে রিভলভার দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন।”
এই মন্তব্যে এজলাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, আইনজীবীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন।
শুনানির শেষ পর্যায়ে আউয়াল বলেন, “নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ক্ষমতা নেই। মৌলিক সংস্কার ছাড়া দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন আসবে না।”
প্রসঙ্গত, গত ২২ জুন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এই মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনজন সাবেক সিইসি—কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ (২০১৪), এ কে এম নূরুল হুদা (২০১৮), ও কাজী হাবিবুল আউয়াল (২০২৪), পাঁচজন সাবেক ও বর্তমান আইজিপিসহ মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়। গতকাল (২৫ জুন) রাজধানীর মগবাজার থেকে হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।