এম আবদুল্লাহ
নিয়মিত লেখালেখির একটা বড় সমস্যা হচ্ছে বিষয় নির্বাচন। বাংলাদেশের মতো বিচিত্র ঘটনা-অঘটনের দেশে ইস্যুর পর ইস্যু সামনে আসে। কোনটা রেখে কোনটা নিয়ে লিখবো তা নিয়ে প্রায়ই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। সাধারণতঃ আমি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে অভ্যস্ত। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণে পাঠকের আগ্রহ বেশি। তবে ইস্যুর নিচে ইস্যু চাপা দেওয়ার ‘হাসিনা কৌশল’ এখন নির্বাসনে থাকলেও আমরা অনেকেই এরই মধ্যে তাতে সংক্রমিত হয়ে পড়েছি বলে আন্দাজ হয়। নন-ইস্যুকে ইস্যু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। ফল হচ্ছে- পতিতরা মুচকি হাসছে। বগল বাজাচ্ছে। গর্ত থেকে মাথা তুলছে। উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। আশাবাদী হয়ে উঠছে। তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের শক্তি।
বিস্ময়করভাবে আলোচনায় নেই জুলাই সনদ। হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে বহুলকাঙ্খিত রাষ্ট্র সংস্কার। ঐকমত্য কমিশন নিয়ম করে দফায় দফায় তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি আর রাজনীতিকদের মজমা বসিয়ে গত পক্ষকাল কেন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কিছু বিষয়ে মতদ্বৈততা আছে। থাকবেই। কোন দেশে, কোন কালে সব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে? তা হলেতো বহুদলের অস্তিত্বই থাকতো না। কাজের কাজটা না করে ঐকমত্য কমিশনের অনেকেই ভবিষ্যৎ লাইন-ঘাট ঠিক করার, ভাবি-সরকারের নেকনজরে থাকার পথে হাটছেন বলে কানাঘুষাও হচ্ছে। অনেকের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পদ-পদবী নিয়েও বোঝাপড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ‘মুলা’র দিকে নজর। ফলে শক্ত কোন অবস্থান নিতে পারছেন না।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনা, তাপস আর ইনু গংদের যে চাঞ্চল্যকর ফোনালাপ ফাঁস করা হলো, তা নিয়েও তেমন কোন আলোচনা-আলোড়ন নেই। শেখ হাসিনার খুনের নির্দেশ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়ে জুলাই বিপ্লবীদের ফাঁসানোর ফন্দি, জঙ্গি কার্ড ব্যবহারের নকশা ইত্যাদির অকাট্য প্রমান হাজির করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা যে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছেন, তাতে কারও যেন আগ্রহ নেই। ‘নির্দেশনা দিয়ে দিছি, যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে’- শেখ হাসিনার এই পরীক্ষিত টেলি-কনভার্সেশন কতজন নিজেদের সোশ্যাল প্লাটফর্মে শেয়ার করেছেন? ডিএমপি কমিশনারের চাইনীজ রাইফেল থেকে কোমরের নিচে গুলি করার ওয়্যারলেস বার্তাও ট্রাইব্যুনালে। জুলাই আন্দোলন দমন ও গণহত্যা-সংশ্লিষ্ট ৬৯টি অডিও ক্লিপ ও ৩টি মোবাইল ফোনের ডাটা ট্রাইব্যুনালে প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করতে পারার জন্যে কোন বিপ্লবী বা বিপ্লবপন্থী প্রসিকিউশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন? সাধুবাদ দিয়ে উৎসাহিত করেছেন ? শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে এসব অকাট্য দলিল যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তা কি জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে তুলে ধরছেন? না। সে ফুরসৎ কারও নেই।
সবাই সরকারের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত। ড. ইউনূস যে ‘শেখ হাসিনার চেয়েও খারাপ শাসক’, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ সরকার’, ‘১৩/১৪ মাসে কিছুই করতে পারেননি’- এমন বয়ান প্রতিষ্ঠায় কম-বেশি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রাখছি সবাই। ৬ রাজনীতিককে কেন সফরসঙ্গী করা হলো, কেন ড. ইউনূস তাদেরকে নিজের গাড়িতে তুলে বিমানবন্দর থেকে বের হলেন না, সফরসঙ্গীর বহর কেন এতো বড়, আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল প্রতিরোধে ড. ইউনূস ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কেন রাস্তায় ও অলিগলিতে পাহারায় দিন-রাত কাটান না- এ ধরণের ইস্যুগুলো এখন সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে!
লুটের ৫৮ হাজার কোটি টাকা যে জব্দ করা সম্ভব হয়েছে, ২৮ লাখ কোটি টাকা লুট-পাচারের তথ্য যে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে উদঘাটন করা গেছে, রিজার্ভের চুরি করা অর্থ যে জব্দ করে ফেরৎ আনার ব্যবস্থা হচ্ছে, ডাকাতির কবলে পড়া ব্যাংকিং খাত যে স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে, রিজার্ভ যে নাজুক ১৫ বিলিয়ন থেকে ৩০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, বাজারের উল্লম্ফন যে থেমেছে, বিচার ব্যবস্থার ধ্বস যে ঠেকানো গেছে, কথায় কথায় গুলি, গুম, খুন না করেও যে প্রায় ১৭শ’ আন্দোলন মোকাবিলা করা গেলো, দলবাজ ও ভঙ্গুর পুলিশ প্রশাসন দিয়ে এখনও যে দেশটা চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে- এসবে কোন সাফল্য দেখার সময় নেই। ফলাফলে শেখ হাসিনার পনের বছরের ভয়াবহ দুঃশাসন, নিপীড়ন, গুম, খুন, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার হরণকে নরমালাইজ করার কাজটি হচ্ছে অতি চাতুর্যের সঙ্গে।
গণহত্যার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসার পাশাপাশি ওই বিচার ও রায়ের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর আওয়ামী কৌশল ও ফাঁদে বুঝে না বুঝে পা দিচ্ছি অনেকেই। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত বুঝতে পারছি না যে, ড. ইউনূসের শাসনের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সাড়ে ৪ মাস পর ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও করা যাবে। কিন্তু পতিত শেখ হাসিনা ও প্রতিবেশি আধিপত্যবাদী শক্তির এক নম্বর শত্রু ড. ইউনূস ও তাঁর সরকার। তিনি দুর্বল হলে, জনগণের আস্থা হারালে শক্তি সঞ্চয় করবে পতিত শক্তি। দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ পাবে। আসন্ন নির্বাচনটিও হুমকির মুখে পড়বে। এটাও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছি যে, প্রচণ্ড জনরোষ থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া খুনি-লুটেরা চক্রকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই শুধু হবে না, সেই বিচারের পক্ষে জনমতকে সক্রিয় ও দৃশ্যমান রাখাটাও জরুরি। ফ্যাসিস্টদের শাস্তি নিশ্চিত করতে তার পক্ষে এক ধরনের ‘পাবলিক ওয়েভ’ তৈরি করতে হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলানোর আগে সরকার ও তার কালচারাল উইংগুলো কী করেছিল তা একবার স্মরণ করতে পারেন।
যে কোন বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের পর পরাজিত শক্তি প্রচলিত আইনী সুরক্ষা ও সুবিধা পাওয়ার নজীর নেই। স্বাভাবিক রাজনৈতিক পালাবদলে তা পেতে পারে। কারণ, বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ক্ষেত্রেও আইন ও মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে না ফ্যাসিস্টরা। যেসব খুনি, লুটেরা ও দাগি অপরাধীদের গ্রেফতার করে জেলে পুরা হয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতি তৈরির চেষ্টা করছে ফ্যাসিস্ট শক্তির সুবিধাভোগী লেসপেন্সাররা। তাদের মানবাধিকার, আইনী অধিকারের নামে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বুঝে, না বুঝে গণঅভ্যুত্থানপন্থী অনেকে তাদের সঙ্গে সুর মিলাতে দেখা যাচ্ছে। সে সুযোগ নিচ্ছে নতুন করে গজিয়ে ওঠা কিছু মানবাধিকার সংগঠন। এসব সংগঠনের কোন অস্তিত্ব গত পনের বছরে দেখা যায়নি।
ডি-কেজ নামক একটি কথিত মানবাধিকার সংগঠন দু’দিন আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে এক আলোচনার আয়োজন করে বলেছে- ‘বাংলাদেশে কারাগারে বন্দীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই বিচারাধীন মামলায় বন্দী হয়ে আছেন। বিচার হলে হয়তো তাঁরা দুই থেকে তিন মাস কারাগারে থাকতেন। কারাগার মানেই মানুষকে শাস্তি দেওয়া। এ মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি’। বিস্ময়কর দিক হচ্ছে- এ আলোচনায় আবার কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন যোগ দিয়েছিলেন। গত ১৫ বছরে গায়েবী ও বানোয়াট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে বিরোধী শিবিরের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বছরের পর বছর কারাবন্দীত্বের সময় এ সংগঠন কোথায় ছিল? লুটেরা ও খুনিদের তিন মাসের মধ্যে মুক্ত করে তাদের অর্থ ও অস্ত্রের শক্তি দিয়ে বিচারকে প্রভাবিত করার সুযোগ করে দিতে চায় তারা। এমনিতে আওয়ামী লীগের দলবাজ পুলিশ ও কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দলীয় ও আর্থিক সখ্যে গ্রেফতারকৃতরা বেশ আরাম আয়েশে আছেন। নোয়াখালীর দুর্ধর্ষ আওয়ামী দুর্বৃত্ত একরাম চৌধুরী কারাগারকে প্রাসাদে পরিনত করার খবর এসেছে পত্রিকায়। কারাগারে তাঁর কক্ষে টাইলস করা হয়েছে, এসি লাগানো হয়েছে। যেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে আছেন!
শুক্রবার দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রে সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের সরাসরি আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন ভারতে পালিয়ে থাকা পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে হাসিনা এ নির্দেশনা দেন। দলের নেতাকর্মীদের হাসিনা বলেন, ‘কোনোভাবেই কেউ যাতে অক্ষত ফিরতে না পারে, সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে’। একজন আইনের মধ্যে থেকে বিক্ষোভের কথা বললে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন- ‘ওরা তো আমাদের কিছুই আর বাকি রাখেনি। ওদের একটাকেও আমি ছাড়ব না’।
শেখ হাসিনার হুকুমে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্তা করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতা মোঃ আখতার হোসেনের পিঠে ডিম মারা হয়েছে। ডিম নিক্ষেপকারীকে গ্রেফতারের পর মুক্ত হলে শেখ হাসিনা ভিডিও কলে তাকে অভিনন্দিত করে বিরোচিত প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। আবার সেই আওয়ামী দুর্বৃত্ত মিজান হুমকি দিয়েছে- প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে নাগালে পেলে রক্ত ঝরাবে। এমন পরিস্থিতিতে বিপ্লবপন্থীদের অনেককে ভার্চুয়াল জগতে ও টকশোতে দেখা গেছে ড. ইউনূসের সফরসঙ্গীদের সংখ্যা নিয়ে মাতামাতি করতে।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ ভাষন দিয়েছেন। সে সময় জাতিসংঘ ভবনের বাইরে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ হয়েছে। এ বিক্ষোভে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের আওয়ামী লীগ সভাপতি কিল-ঘুষি খেয়ে হাউমাউ করে কান্নাকাটির ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বিএনপি-জমায়াত কর্মীদের দুষছিলেন। আরও একাধিক আওয়ামী লীগ কর্মী কমবেশি মার খেয়েছেন। এয়ারপোর্টের নোংরামি পাটকেল হয়ে তাদের ওপর আঘাত হেনেছে জাতিসংঘ ভবনের সামনে। এটা অনাকাঙ্খিত। পুলিশকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে দু’পক্ষকে সামলাতে। শুধু আমেরিকা নয়, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে আওয়ামী নেতাকর্মীদের সমাবেশ ঘটানো হয় নিউইয়র্কে। ড. ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গীদের ‘ক্ষত’ করতে গিয়ে তারা অনেকে ‘অক্ষত’ যেতে পারেননি। অথচ হুকুমদাতারা আছেন বিলাসী জীবনে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘ সফরে সঙ্গী হিসেবে ১০৪ জনের তথ্য দিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলা হয়েছে। বিলম্বে হলেও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রেস সচিব। বাস্তবে এতটা সমালোচনার মতো ঘটনা ঘটেছে কিনা তা একবার পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছি আমি নিজেও। ভিভিআইপি সফরে দু’টি তালিকা থাকে। একটি প্রকৃত সফরসঙ্গীর তালিকা। যারা বাংলাদেশ থেকে একই বিমানে সঙ্গী হন। সফর-সংক্রান্ত একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। তাতে যাদের নাম থাকে তারাই সরকারি সফরে প্রকৃত সফরসঙ্গী। এবারে প্রধান উপদেষ্টার এমন সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৬২। গত বছর ছিল এ সংখ্যা ৫৭। এই সফরসঙ্গীদের মধ্যে উপদেষ্টাদের পাশাপাশি রয়েছেন তিনটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন নেতা।
সফরসঙ্গীর তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর দুই কন্যা, উপদেষ্টা ও সমমর্যাদার ৬ জন রয়েছেন। মুখ্য সচিব, সামরিক সচিব, পিজিআর কমান্ডার, চিকিৎসকসহ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ৯জন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা এবং বিডার প্রধান রয়েছেন। মিডিয়া টিমে গেছেন প্রেস উইংয়ের ৫ সদস্য। রীতি অনুযায়ী বিটিভি, বাসস ও ইউএনবি থেকে একজন প্রতিবেদক ও বিটিভি’র ক্যামেরাপার্সন গেছেন। অর্থাৎ প্রেস টিমসহ প্রকৃত সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৪০। এর সঙ্গে ব্যতিক্রম হিসেবে রাজনীতিক ৬ জন যোগ হয়ে ৪৬ জন। তন্মধ্যে একজন নিউইয়র্ক থেকে যুক্ত হযেছেন। মানে মূল সফর সঙ্গী ৪৫ জন তাঁর সঙ্গে বিমানে ঢাকা থেকে গিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে-তা হলে ১০৪ সদেস্যের বাকিরা কারা? তালিকা অনুযায়ী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ কর্মকর্তা ও সদস্যদের মধ্য থেকে দু’টি ক্যাটাগরিতে থেকে ১৯ জন অগ্রবর্তী নিরাপত্তা সদস্য ও সহযোগী নিরাপত্তা সদস্য হিসেবে গেছেন। আইন ও বিধি অনুযায়ী নিরাপত্তা দলের সদস্য নির্ধারণ করা হয় স্বাধীনভাবে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও ঝুঁকি বিবেচনায়। এ ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার নেই বললেই চলে। এবারে আওয়ামী লীগের হুমকির কারণে সম্ভবত নিরাপত্তা টিমের সদস্য বাড়ানো হয়েছে।
১০৪ জানের তালিকার বাকি সবাই সে অর্থে সফরসঙ্গী নন। তারা মূলতঃ জাতিসংঘ মিশন ও নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের সদস্য। প্রটোকলে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এদের কেউ কেউ অন্যান্য দেশের মিশন থেকেও সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। বহরটি হয়তো আরও একটু ছোট করা যেত। রাষ্ট্রীয় অর্থের সাশ্রয় হতো। কিন্তু শেখ হাসিনার পনের বছর ধরে দু’শ থেকে আড়াইশ’ সদস্যের লটবহরের তুলনায় এটি অবশ্যই ছোট ও সাশ্রয়ী। ২০১৯ সালে ২৯২ জন নিয়ে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন টিআইবি কোন বিবৃতি দিয়েছিল কিনা গুগলের সহযোগিতা চেয়ে খুঁজে পেলাম না। একটি টিভি টকশোতে দেখলাম ড. ইউনূসের সঙ্গে দুই কন্যার সঙ্গী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করে বলা হয়েছে দুই মেয়ের কী কাজ? একজন বয়ষ্ক মানুষ। স্ত্রী অসুস্থ থাকায় সঙ্গী হতে পারেননি। ব্যক্তিগত কত সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সে সব কে দেখবেন? বিগত সময়ে পুত্র, কন্যা, নাতি-পুতি, খালাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই ও তাদের চৌদ্দগোষ্ঠীকে সফরসঙ্গী করার সময় এমন প্রশ্ন টকশোতে তোলার মুরোদ কোন টেলিভিশনের হয়নি। এটাই নতুন বাংলাদেশ। সরকার প্রধানের উদ্দেশ্যে কারণে-অকারণে আঙ্গুল তুলতে পারছেন।
সফরের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অবশ্যই তুলতে পারেন। মনে রাখতে হবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যোগদানের সফরটি বার্ষিক রুটিন সফর। তবুও সরকার প্রধান হিসেবে সাইড লাইনে সম্ভবতঃ ড. ইউনূসই সর্বাধিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেছেন। গণঅভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা জানান দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। বস্ত্র খাতের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন। কয়েকটি দেশের কাছ থেকে জনশক্তি রফতানির আশ্বাস আদায় করেছেন। আরও বিস্তারিত হয়তো তাঁর ফেরার পর জানা যাবে।
দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে বড় কোন ইস্যুকে চাপা দিতে পরিকল্পিতভাবে নানা ঘটনা ঘটাতেন। মানুষের দৃষ্টি ফেরানোতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এবারও নিউইয়র্কে ড. ইউনূসকে ম্লান করতে বড় বাজেটে নেতাকর্মীদের সমবেত করে ঘটনা-অঘটনের বড় পরিকল্পনা করেছিলেন। কিছুটা সফলও হয়েছেন। তবে ড. ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গীরা এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত অক্ষতই আছেন। আশা করি অক্ষতই ফিরবেন। তবে সফরের উজ্জ্বল দিকগুলোকে মলিন করার শেখ হাসিনার দূরভিসন্ধির ফাঁদে অনেক বিপ্লবপন্থীর পা দেওয়া হতাশাজনক। আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দেখাই হয়নি বলে প্রচার করে বিকৃত আনন্দ করছিলেন। শেষে দেখা গেল নৈশভোজে সাক্ষাতই শুধু হয়নি, হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশনও হয়েছে। এভাবে শেখ হাসিনার ফাঁদে পা দিতে থাকলে বিপ্লবপন্থীরা যেমন একদিন সত্যি সত্যি অক্ষত থাকতে পারবেন না, তেমনি আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরাও যে লাঞ্ছিত হবেন তা-তো নগদেই প্রমানিত হলো।
এম আবদুল্লাহ : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক।