বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১১ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন: একটি বাস্তবধর্মী রূপরেখা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতিতে “জুলাই সনদ” এক ঐতিহাসিক ও দিকনির্দেশনামূলক প্রস্তাবনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি কেবল একটি দলীয় কর্মসূচি নয়, বরং জাতীয় পুনর্গঠনের একটি বৃহৎ রূপরেখা। এই সনদের মূল প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক অঙ্গনে একটি মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হতে পারে। তবে এর বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘমেয়াদী, ধৈর্যপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া, যার প্রতিটি ধাপে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনসম্পৃক্ততা ও সাংবিধানিক সক্ষমতা।

প্রথমত, এই সনদ বাস্তবায়নের সূচনা হবে একটি সর্বদলীয় সংলাপ ও ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে দীর্ঘদিনের বিভক্তি ও আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হলে একটি গ্রহণযোগ্য আলোচনার পরিসর তৈরি করা অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদ, নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদেরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। নিরপেক্ষভাবে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হলে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব, যার ভিত্তিতে সংবিধান ও নির্বাচনসংক্রান্ত কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে।

নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনাই জুলাই সনদের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। এই লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ এবং আইনি ভিত্তি সম্পন্ন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধন এনে কমিশন গঠনের জন্য একটি সংসদীয় পদ্ধতি নির্ধারণ। ইভিএম ব্যবস্থার বিতর্কিত ব্যবহার পরিহার করে কাগুজে ব্যালট ও অবাধ ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ভোটার তালিকার নির্ভুলতা, নির্বাচনী আচরণবিধির কার্যকর প্রয়োগ এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা এই সনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের প্রশাসনিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানে সংশোধন এনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি, বিচারাধীন মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি জনআস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন যথাযথ বাজেট বরাদ্দ, ডিজিটাল কোর্ট ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বিচারকদের নিরাপত্তা ও পেশাগত মর্যাদা রক্ষা।

প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহকে নিরপেক্ষ, পেশাদার ও মানবাধিকারবান্ধব কাঠামোর আওতায় আনা জরুরি। অতীতে গুম, খুন ও বেআইনি আটক নিয়ে যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তা তদন্তে একটি স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য কমিশন গঠন করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর সংসদীয় নজরদারি প্রতিষ্ঠা এবং বাহিনীর অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে যাতে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়।

অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লুটপাট, দুর্নীতি ও কালো টাকার প্রবাহ রোধ করার ওপর জোর দিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনতা দিয়ে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করতে হবে। টিআইবি ও অন্যান্য সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী আইন হালনাগাদ করে এর প্রয়োগে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার, টাকা পাচার রোধ এবং সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা আনতে হবে।

এই সনদে নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা অন্যতম অগ্রাধিকার পেয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল দমনমূলক আইন বাতিল বা মৌলিক অধিকারসম্মত সংস্কার করতে হবে। সাংবাদিক নির্যাতন ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নাগরিকদের ওপর নজরদারি নিরুৎসাহিত করা এবং সাইবার গোপনীয়তা রক্ষা আইন প্রণয়নও জরুরি।

স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও কার্যকর করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রেখে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি স্থানীয় সরকারের বাজেট, প্রকল্প ও জনসেবা কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা, যুব ও কর্মসংস্থান খাতে নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি সময়োপযোগী ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষানীতি প্রণয়ন, কর্মমুখী শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির প্রয়োগও জুলাই সনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্ত হত্যা রোধ, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুসংহত করতে হবে।

“জুলাই সনদ” বাস্তবায়ন একটি রূপান্তরমূলক যাত্রা, যা কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং সমগ্র জাতির সক্রিয় অংশগ্রহণ, আস্থার পুনঃস্থাপন এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসের ভিত্তিতে সফল হতে পারে। এ পথে প্রতিবন্ধকতা যেমন থাকবে, তেমনি সঠিক নেতৃত্ব, সম্মিলিত উদ্যোগ ও সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা থাকলে তা অতিক্রম করাও সম্ভব। এই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন মানেই একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে জনগণই হবে ক্ষমতার মূল উৎস।