শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

ধোঁয়াশায় নির্বাচনী রোডম্যাপ: তবুও চলছে নীরব প্রস্তুতি

সৈয়দ শামছুল হুদা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো কোনো রোডম্যাপ এখানো ঘোষণা হয়নি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো ভোট নিয়ে নানা হিসেব নিকেষ শুরু করে দিয়েছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ভোটের জোট করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিনিয়ত এসব বিষয়ে আলোচনা বাড়ছে। মেরুকরণ হচ্ছে। ছোট দলগুলোর হিসাব এবং বড় দলগুলোর হিসাব যদিও একনয়, তথাপি তারা পরস্পরের দিকে মুখিয়ে আছে।
আওয়ামী লীগবিহীন মাঠে দৃশ্যমান হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা তৎপরতা। ছোট ছোট দলগুলোকে বিএনপি কাছে টানার চেষ্টা করছে। পিছিয়ে নেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশও। তারাও বিভিন্ন ইসলামিক দলগুলোর কাছে ধর্না দিচ্ছে। তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে পরস্পরে কুশল বিনিময় করছে। অপরদিকে সদ্য গঠিত এনসিপি’র পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক বলয় তৈরির তৎপরতা চেষ্টাও লক্ষ্যণীয়। বিএনপির আহ্বানে বাম গণতান্ত্রিক জোটের দুটি দল সিপিবি-বাসদের শীর্ষ নেতারা একবার বসেছে। বৈঠকে তাদের আলোচনার মুল বিষয় ছিল নির্বাচন। বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে দাবি করছে, দলটি সেই দাবির প্রতি সিপিবি-বাসদের নেতাদের সমর্থন চেয়েছে। সিপিবি-বাসদের নেতারাও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপি ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বাইরে স্বতন্ত্র বাম গণতান্ত্রিক জোটে রয়েছে সিপিবি ও বাসদ।
এবার জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে দল দুটোর বৈঠকে একটি রাজনৈতিক জোটে রূপ নিতে পারে, এমন আলোচনা শুরু হলেও সিপিবি-বাসদ অবশ্য এখনই সে ঘোষণা দিতে নারাজ। তবে বিএনপি এ মুহূর্তে কোনো জোট গঠনের কথা না বললেও ছোট দলগুলোকে তাদের পক্ষে রাখতে চাইছে। সেজন্য বিভিন্ন দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে তারা। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্যান্য ইসলামী দলের ঐক্য নিয়েও ভেতরে ভেতরে তৎপরতা চলছে। জামায়াত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাথে বৈঠক করেছে। খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য আরও কয়েকটি দলের সাথেও বৈঠক করেছে। তারাও চাচ্ছে যে কোনো মূল্যে এ বছর ভালো একটি অবস্থান তৈরি করতে। অতীতের দূরত্ব এবং ছোট-খাট ভুল মুছে ফেলে নতুন গতিতে তারাও এগিয়ে যেতে চায়। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক মাঠে জামায়াত খুব শক্তভাবেই অবস্থান নিয়েছে। প্রশাসন থেকে নিয়ে শুরু করে তৃণমূলের সর্বত্র জামায়াতের নিজস্ব বলয় তৈরি হয়েছে। জামায়াত এটাকে কাজে লাগাতে চায়। তৃণমূরের জামায়াতও অনেক আশাবাদি হয়ে উঠেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল এনসিপিও বৈঠক করছে বিভিন্ন দলের সঙ্গে। এমন পরিস্থিতিতেও বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি’র তৎপরতায় রাজনীতিতে স্পষ্ট হচ্ছে তিনটি বলয়। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক দল একসঙ্গে ভূমিকা রেখেছিলো, সেই দলগুলোর মধ্যে এখন বিভক্তি স্পষ্ট। নির্বাচন এবং সম্ভাব্য ক্ষমতার লড়াইয়ে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এনসিপিও রাজনীতিতে তৎপর হয়েছে নিজস্ব বক্তব্য নিয়ে। বিএনপি ছোট ছোট দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে চলতি বছরের প্রথম থেকেই। প্রথম বৈঠক হয় খেলাফত মজলিসের সঙ্গে। এরপর আরেকটি দলের সঙ্গে বৈঠক হলেও পরে আর এ নিয়ে খুব একটা এগোয়নি দলটি। তবে কয়েকমাস পর আবারও তৎপর হয়েছে বিএনপি। মূলত: ডিসেম্বরে নির্বাচন আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পাওয়ার পরই বিএনপি ছোট দলগুলোর সঙ্গে আবার আলোচনা শুরু করেছে। যেটাকে অনেকেই বলছেন, একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ। যদিও বিএনপি এখনই সেটা বলছে না। এটা কোনো জোটের রূপ না। আমরা চাচ্ছি জনগণের কাছে যাওয়ার জন্য। নির্বাচন নিয়ে জনগণের যে দাবি, সেটা নিয়েই দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়ায় আছে অতীতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, এলডিপি, লেবার পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের মতো দলগুলো। এর বাইরেও বিভিন্ন দলকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বিএনপি। প্রাথমিকভাবে এসব বৈঠক শেষে ডিসেম্বরে যেন নির্বাচন হয়, সেই দাবিতে প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চিন্তা রয়েছে। কিন্তু সেটা কি জোটগতভাবে হবে নাকি আলাদা- এমন প্রশ্নে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, জোটগত আন্দোলনের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। তিনি বলেন, পরিস্থিতিই সব বলে দেবে। তবে আমরা আশা করি, আন্দোলনের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না।”
এদিকে জামায়াত ইসলামী বলছে, ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হলেও সেখানে নির্বাচন কবে হবে, সংস্কার কী হবে -এ ধরণের কোনোও বিষয় নিয়ে তারা কাজ করছেন না। “জোট দুই ধরনের হয়। একটা হয় আন্দোলনের, আরেকটা হয় নির্বাচনের। আমরা নির্বাচনী জোট করতে চাই। ইসলামী দলগুলো সকলেই এটা বলছে যে, জাতীয় নির্বাচনে আমরা বিভিন্ন আসনে ইসলামী দলগুলো থেকে একক প্রার্থী রাখবো। ইসলামী দলগুলোর একাধিক প্রার্থী যেন না থাকে। এই আলোচনাই চলছে। সুতরাং এই জোট যখন হবে, সেটা নির্বাচন কেন্দ্রীক হবে। এদিকে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া এনসিপি বলছে- তারা কোনো জোটের দিকে ঝুঁকবে না। তবে এনসিপির নেতারা বৈঠক করেছে খেলাফত মজলিসের নেতাদের সঙ্গে। এর আগে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সাথেও বৈঠক করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলাম হেফাজত আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। ইসলামী দলগুলো দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিছু পুরাতন দল চাচ্ছে তারা বিএনপির সাথে থাকবে। যেমন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তারা মনে করে যে, বিএনপি বড় দল। তাদের একটা ভবিষ্যত আছে। এছাড়া বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করে অতীতেও তারা ভালো করেছে। মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী জমিয়ত থেকে বিএনপির প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিল। যদিও এককভাবে নির্বাচন করলে তারা কোনোভাবেই পাশ করবে না। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও বিএনপির সাথেই নির্বাচনী জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাথে নেজামে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচন করতে পারে। জামায়াতের সাথে আলোচনা চললেও আদর্শগত কারণে সবশেষে তাদের ঐক্য কতটা দৃঢ় হবে তাতে সন্দেহ আছে। ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী প্রতীক এক হলে তারা নির্বাচনে কিছুটা ভালো করবেন আশা করা যায়। এককভাবে নির্বাচন করলে সকলেই গো হারা হারবেন এটা নিশ্চিত। হেফাজতের ব্যানারে যে সকল ইসলামী দল আছে তারা পরোক্ষভাবে বিএনপির দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের ভোটের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব আছে, এটা ২০০১ এর নির্বাচনেও প্রমাণিত হয়েছে। তবে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তারা ভালো করতে পারে না।
এনসিপি ধীরে ধীরে মাঠ গোছাচ্ছে। গত ১৬ মে তাদের যুব শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের জন্য সামান্তা এর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের এক অনুসন্ধানী টিম গঠন করেছে। মাঝে মাঝে এনসিপির কিছু নেতার মুখ ফসকে বের হয়ে যাওয়া কথার কারণে বিপদে পড়লেও তারা এটা বুঝে গেছে যে, ইসলামী দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া তারাও নির্বাচনে ভালো করতে পারবে না। আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর ভালো কদর থাকবে এটা বুঝা যায়। এবি পার্টি কোনদিকে যাবে তা স্পষ্ট না হলেও গণঅধিকার পরিষদ বিএনপির সাথে ইতিমধ্যেই জোটগত আলোচনা সেরে রেখেছে। সবমিলিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি আগামী নির্বাচনে বেশ আলোচনায় থাকবে এটা দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়।

এসএসএইচ.