রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের পাসপোর্টে সন্তু লারমার ভারত সফর!

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি : তিনি কখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেননি। তিনি কখনো রাষ্ট্রীয় মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও অমর একুশে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্মতিস্তম্ভে ফুল দিতে যাননি। যদিওবা তার গাড়ী, বাড়ী ও অফিসে জাতীয় পতাকা উড়ে। তবে ২০১৯ সালে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মহামারি করোনা তাকে বাধ্য করেছে বাংলাদেশে নাগরিকত্ব স্বীকার করতে। তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রথম বাংলাদেশের পাসপোর্টে তিনি ভারত সফরে গেছেন।

তিনি হচ্ছেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার কথা। যার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩০ হাজার পাহাড়ি, বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।

সন্তু লারমা প্রায় দুই যগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আসীন রয়েছেন। অনির্বাচিত এই পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পিছনে ২৬ বছর ধরে সরকারের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, সন্তু লারমা সরকারের সাথে চুক্তি করে অস্ত্র সমর্পনের নাটক করলেও তার বিশাল সশস্ত্র বাহিনী পাহাড়ে এখনো অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। প্রতিপক্ষের সাথে বন্দুক লড়াইয়ে জড়াচ্ছে। পাহাড় জুড়ে সাধারন মানুষকে জিন্মি করে শত শত কোটি টাকা চাঁদাবাজি করছে। সরকারের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে জঙ্গলে যাওয়ার দিচ্ছে। যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল।


একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৩ মে দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দুইজন সফরসঙ্গী নিয়ে ভারত গমন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। আর এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের পাসপোর্টে সন্তু লারমার প্রথম ভারত সফর।
সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাংবাদিকদের স্পষ্ট কিছু না বললেও সন্তু লারমার ব্যক্তিগত সহকারী শ্যামল জানান, ভারতের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এবার তিনি চিকিৎসা ও ধর্মীয় কাজে ভারত সফরে গেছেন।


পাহাড়ে সন্ত্রাস ও সহিংসতা বন্ধে ১৯৯১ সালে বিএনপির সরকারের আমলে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল(অব:) অলি আহমেদের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতি রিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার সাথে আলোচনা শুরু হয়।


তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালে ২ রা ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক সংগঠন জ্যোতিরিদ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর সে চুক্তির ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ।


পার্বত্য চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ প্রণয়ন করে সরকার। এই আইনের অধীনে গঠিত আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা ও অপর ২৫ পরিষদের সদস্য ১৯৯৯ সালের ১২ মে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই ‘চলছে গাড়ি-যাত্রাবাড়ি’ অবস্থা। না আছে নির্বাচন, না আছে বদলানোর অন্যকোনো ব্যবস্থা।


অনির্বাচিত এই পরিষদ গত ২৬ বছর ধরে চলছে, চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের পেছনে সরকার বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছেন। কিন্তু এই পরিষদ থেকে দেশ ও জনগণ কি পাচ্ছেন এ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। বরং সংকটকালে পাহাড়ের জনগণ এই পরিষদের চেয়ারম্যান বা কোনো সদস্যকে তাদের পাশে পেয়েছে বলে কারো জানা নেই। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই পরিষদের চেয়ারম্যান কাগুজে বাঘ সন্তু লারমা তার সন্ত্রাসী বাহিনীর হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে পরিচিত হলেও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কারা এবং তাদের কাজই-বা কী তা জানে না কেউই।


অভিযোগ রয়েছে, চুক্তির আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে প্রায় ত্রিশ হাজার বাঙালি, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও সাধারন পাহাড়ি প্রাণ হারিয়েছেন।


সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্য চুক্তিতেই এমন কিছু ধারা সংযোজিত হয়েছে যা বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান ও প্রচলিত বহু আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একইসঙ্গে তা বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক। পার্বত্য চুক্তির ২৬টি জাতীয় আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট ১২টি আইনসহ মোট ৩৮টি আইন সংবিধান বিরোধী। আঞ্চলিক পরিষদ আইনটি রাষ্ট্রের একক চরিত্র ধ্বংস করেছে বিধায় এটি অসাংবিধানিক। এ ছাড়াও সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক এই আঞ্চলিক পরিষদ কোন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নয়। অথচ অসংবিধানিকভাবে দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে আঞ্চলিক পরিষদের পিছনে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। যা জনগণের কোনো কল্যাণে কাজে লাগছে না।


অভিযোগ রয়েছে, জ্যোতিরিদ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হলেও সে সময় তিনি বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন না। তিনি কখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করেননি। এ কারণে ভোটারও হননি। তিনি ভারতের পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। তবে মহামারি করোনা তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে বাধ্য করে।


একটি সূত্র জানায়,২০১৯ সালে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় সন্তু লারমা করোনা টিকা নিতে ভোটার আইডি না থাকায় তিনি টিকা নিতে পারেননি। পরে নিজের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে তিনি বাংলাদেশের ভোটার হয়ে করোনা টিকা নেন।


অভিযোগে জানা যায়, সন্তু লারমা পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে সরকারের সাথে চুক্তি করাটা ছিল নাটক। কিছু ভাঙাচুরা অস্ত্র জমা দিলেও ভারী আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেননি। তার প্রমাণ চুক্তির পর বহুবার সন্তু লারমার সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যও। চুক্তির পর একাধিকবার নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সন্তু লারমার সন্ত্রাসী বাহিনীর গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সন্তু লারমার সন্ত্রাসী বাহিনীর আস্তানা থেকে উদ্বার হয়েছে এম ১৬ রাইফেল, মিয়ানমারে তৈরি এম ১ রাইফেল, একে ৪৭ রাইফেল, একে ২২ রাইফেল এবং এলএমজি (লাইট মেশিনগান), হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেলের মত ভয়ঙ্কর আগ্নেয়াস্ত্র।


অনুসন্ধানে দেখা গেছে,তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতির বিরোধীতা করে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিদ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার বড় ভাই মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিজিজেএসএস)। জনগণের অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ১৯৭২ সালে সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সাল নাগাদ ভারতের সহযোগিতায় বিপুল সংখ্যক পাহাড়ি যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ১৯৭৭ সালে শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর টহল দলের উপর হামলা শুরু করে এবং মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা আত্মগোপনে চলে যান। শুরু হয় নিরাপত্তাবাহিনী ও বাঙালিদের উপর আক্রমণ ও হত্যা। শুধু তাই নয়, তাদের মতাদর্শ বিরোধী অনেক উপজাতীয়কে হত্যা করা হয়। সে সাথে সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধন, অপহরণ ও জোরপূর্বক চাঁদা আদায়সহ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানো হয়।


৮০ দশকের শুরুর দিকে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জেএসএসের সভাপতি ও সশস্ত্র শান্তি বাহিনীর প্রধান মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ছোট ভাই শান্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমাকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে শান্তি আলোচনার স্বার্থে সন্তু লারমাকেও মুক্তি দেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। কিন্তু মুক্তি পেয়ে কথা রাখেননি সন্তু লারমা। বরং জঙ্গলে আক্রমন আরো জোরদার করেন।


১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর অন্তর্দলীয় কোন্দলে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার ভগবান টিলা এলাকায় মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা নিহত হলে সন্তু লারমা জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে আসেন। সেই সন্তু লারমা গত প্রায় দুই যুগেরও অধিক সময় প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, যারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না এমন ব্যক্তির পরিবর্তে দেশ প্রেমিক কোন ব্যক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান বসানো জরুরী।