বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১১ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পরই যুদ্ধবিরতি : অবশেষে হার মানল ‘মরুডাকাত’ ইসরাইল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইরাক যুদ্ধের সেই টানা ৮ বছরের দম নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল ইরান। ১৩ জুন ইসরাইলের অতর্কিত হামলার পর থেকেই সেই ইতিহাসই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। তেল বাজারে মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলা, যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে গেলেই সর্বাত্মক যুদ্ধের দামামা-সবমিলিয়ে আঁতকে উঠেছিল পুরো বিশ্ব। কিন্তু দিনশেষে ঘটল ঠিক উলেটোটা-বছর দূরের কথা এক মাসও ধোপে টিকল না ‘মরুডাকাত’ ইসরাইল। মাত্র ১২ দিনেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে গেল। মুখে জয়ের ফেনা তুললেই বস্তুত ইরানের শর্ত মেনে (মঙ্গলবার সকালে) নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি মেনে নেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এর ঠিক দুদিন আগেই (১০ দিনে) ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে খবর বেরিয়েছিল-যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দপ্তরে জোর তদবির শুরু করেছে ইসরাইল। সে হিসাবে যুদ্ধবিরতির কয়েকদিন আগে থেকেই যে হার মেনে বসে ছিল ইসরাইল তা নিঃসন্দেহ। রাজপথ ভেসে যাওয়া ইরানিদের বাঁধভাঙা খুশির জোয়ারই তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। যুদ্ধবিরতি পাকাপোক্ত হতেই ইরানজুড়ে এদিন বিজয় মিছিল করে দেশটির সর্বস্তরের মানুষ। উলটোদিকে ইসারইলেরে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সকাল থেকে সর্বশেষ রাত পর্যন্ত ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ হয়েছে বলে বারবার ইসরাইলের গণমাধ্যমে শোরগোল তুললেও জনমনে তার বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই। জয়োল্লাস নেই, বিজয়-পার্টি নেই। পশ্চিমা গণমাধ্যমের কোথাও তাদের খুশির ঝলক আসেনি। তবে স্বস্তি এসেছে তা নিশ্চিত। কারণ যুদ্ধবিরতির পরপরই স্কুলগুলো আবার খুলে দেওয়ার নোটিশ দিয়েছে তেল আবিব। চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছে বাংকারের বাইরে আসারও।- খবর বিবিসি, সিএনএন, এএফপি’র।

টানা ১২ দিনের ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, হাজারো প্রাণহানি ও বিপর্যয়ের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় মধ্যপ্রাচ্যের দুই বৈরী শক্তি-ইরান ও ইসরাইল। মঙ্গলবার সকালে (স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার কিছু পর) এই ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ঘাঁটিতে হামলার পরপরই কাতারের মধ্যস্থতায় কার্যকর হলো এই যুদ্ধবিরতি। ইরান-ইসরাইল দুপক্ষই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি হলেও আস্থার সংকট এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে যাচ্ছে আগের মতোই।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, শর্ত সাপেক্ষে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে ইসরাইল। শর্ত হলো, ইরানকে ইসরাইলে হামলা চালানো বন্ধ করতে হবে। ইসরাইলের দেওয়া এই শর্তে সম্মত হয়েছে ইরান। হোয়াইট হাউজের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সিএনএনকে এই তথ্য জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরই এ ঘোষণা দেন ট্রাম্প। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ইসরাইলের বীরসেবায় ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। তছনছ করে দিয়েছে বীরসেবার বেশ কয়েকটি অবকাঠামো। কয়েক ঘণ্টা পরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার পর আর হামলা চালায়নি ইরান। ট্রাম্পের ঘোষণার পর ইরানের রাজধানী তেহরানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বেশকিছু এলাকাতেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। সেই সময় মেহর নিউজ জানিয়েছে, তেহরানের বাইরে আরও কিছু শহরেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। সেসব শহরের নাম প্রকাশ করা হয়নি। বিপরীতে ইরানও ইসরাইলে হামলার জবাব দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ আবদুলরহিম মুসাভি দাবি করেছেন, গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেহরান ইসরাইলের দিকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়েনি। এর আগে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর ইরান ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে বলে যে খবরটি প্রকাশ হয়েছে তা মিথ্যা। এদিকে ইউরোপে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে রওয়ানা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির শর্ত ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা লঙ্ঘন করায় তিনি ইসরাইল ও ইরান দুপক্ষের ওপরই ক্ষুব্ধ। তবে ইরানের বিরুদ্ধে আর কোনো সামরিক হামলা চালানো হবে না বলে নিশ্চিত করেছেন ট্রাম্প। মঙ্গলবার নিজস্ব মালিকানাধীন সামাজিকমাধ্যম সোশ্যাল ট্র–থে তিনি লেখেন, ‘ইসরাইল আর ইরানকে আক্রমণ করবে না। যুদ্ধবিমানগুলো ‘বন্ধুত্বসূচক প্রদর্শন’র মাধ্যমে ইরানকে শান্তির বার্তা দিয়ে ফিরে যাবে।’

এরই মধ্যে নিজের সুরও পালটে ফেললেন ট্রাম্প। বলেছেন, তিনি ইরানে শাসনের পরিবর্তন চান না। এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেছেন, আমি শাসন পরিবর্তনের পক্ষে নই। তাতে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তবে এই মন্তব্য তার আগের বক্তব্যের পুরোপুরি উলেটো। মাত্র কয়েকদিন আগেই ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, শাসন পরিবর্তন কথাটা হয়তো রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়। কিন্তু যদি ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ‘মেক ইরান গ্রেট এগেইন’ করতে না পারে, তাহলে শাসন পরিবর্তনই বা কেন নয়? যুদ্ধবিরতি কার্যকরের কয়েক ঘন্টা পরে ট্রুথ সোশ্যালের নতুন পোস্টে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ‘ধ্বংস’ করাকে ‘সম্মানের’ বলে মন্তব্য করেছে। বলেছেন, সব পারমাণবিক স্থাপনা এবং সক্ষমতা ধ্বংস করা এবং তারপর যুদ্ধ বন্ধ করা আমার জন্য মহান সম্মানের ছিল।

ইসরাইল যুদ্ধবিরতি মানলে ইরান লঙ্ঘন করবে না : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত যুদ্ধবিরতি ইরান মেনে চলবে। তবে শর্ত একটাই-ইসরাইল যেন এটিকে লঙ্ঘন না করে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, যদি ইসরাইল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন না করে, তাহলে ইরানও তা করবে না। তিনি আরও বলেন, ইরানি জনগণ আবারও প্রমাণ করেছে, কিছু সমস্যা বা ক্ষোভ থাকলেও তারা শত্রুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একত্রিতভাবে রুখে দাঁড়াবে।

পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাবে ইরান : ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলা সত্ত্বেও পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ‘প্রয়োজনীয় উদ্যোগ’ নিয়েছে বলে জানিয়েছে ইরান সরকার। মঙ্গলবার ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ ইসলামি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতি যাচাই করছি।’

‘কার্যক্রম আবার শুরুর পরিকল্পনা আগেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। আমাদের কৌশল এটাই ছিল যাতে উৎপাদন ও সংশ্লিষ্ট সেবায় বিঘ্ন না ঘটে,’ যোগ করেন তিনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির এক উপদেষ্টা জানান, দেশটির কাছে এখনো পরিশোধিত ইউরেনিয়ামের মজুত আছে। এখনো ‘খেলা শেষ হয়নি’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

১৩ জুন ইরানে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে শত শত নিরীহ নাগরিক, শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে বর্বর ইসরাইলি বাহিনী। এরপর থেকে ইসরাইলে একের পর এক ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে থাকে ইরানও। দুই দেশের পালটাপালটি হামলায় ২৪ ইসরাইলি ও ৬০০-এর বেশি ইরানি নিহত হয়েছেন। টানা ১২ দিনের হামলা-পালটাহামলার পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় দুই দেশ।