মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১ পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪ জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

মাসের পর মাস হাদিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল; তফসিলের পরদিন কার্যকর

নিজস্ব প্রতিবেদক: শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার ঘটনায় একটি সুসংগঠিত নেটওয়ার্কের সম্পৃক্ততার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, কয়েক মাস ধরে পরিকল্পিতভাবে এই হামলার ছক কষা হয় এবং ঘটনার পরপরই অভিযুক্তদের দেশত্যাগের প্রস্তুতিও ছিল।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হামলার উদ্দেশ্য ছিল কেবল একজন রাজনৈতিক সংগঠককে হত্যা নয়; বরং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই দেশে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করা। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হামলার দিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনার ঘটনাও ঘটে।

পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে এখন পর্যন্ত তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে গুলি চালান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল (অন্য নাম দাউদ খান), মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন আলমগীর শেখ। ঘটনার আগে হাদিকে অনুসরণ বা রেকির সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আরও একজন—রুবেল। তিনি আদাবর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী বলে পুলিশ দাবি করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হাদির বিভিন্ন গণসংযোগ কর্মসূচিতে এই তিনজনের একসঙ্গে উপস্থিত থাকার একাধিক ছবি এসেছে, যা ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। শনাক্ত তিনজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

তদন্তে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি, হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে অন্তত দুই মাস ধরে তাঁকে নিয়মিত অনুসরণ করা হচ্ছিল। তফসিল ঘোষণার পরদিন হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতা তৈরিই ছিল মূল লক্ষ্য। ওই দিন রাতেই রাজধানীর বাড্ডায় বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে, বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ হয় এবং লক্ষ্মীপুরে একটি নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

হামলার পর মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে শুটার ফয়সল করিম মাসুদ ও মোটরসাইকেলচালক আলমগীর শেখ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। তাঁদের সম্ভাব্য অবস্থান চিহ্নিত করে শনিবার রাতেই হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান চালানো হয়।

অভিযানকালে মানব পাচারের অভিযোগে সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরন দিও নামে দুই ব্যক্তিকে আটক করে ঢাকায় আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সঞ্জয় চিসিম জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে তিনি দুজন বাংলাদেশি নাগরিককে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশে সহায়তা করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, ওই দুজনই ফয়সল ও আলমগীর।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) এস এন নজরুল ইসলাম রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অবৈধ লোক পারাপারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক দুই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম জানান, ফয়সল করিমের পাসপোর্ট নম্বর পাওয়া গেছে। ইমিগ্রেশন তথ্য অনুযায়ী, তিনি সর্বশেষ গত জুলাই মাসে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফেরেন। এরপর তাঁর কোনো বৈধ বহির্গমনের তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সলের চলাচলের খতিয়ান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আইটি ব্যবসায়ী পরিচয়ে তিনি গত কয়েক বছরে একাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সর্বশেষ ২১ জুলাই সিঙ্গাপুর সফরের তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে তদন্তের অংশ হিসেবে ফয়সল করিমের স্ত্রী, শ্যালক ও তাঁর বান্ধবীকে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করেছে র‍্যাব। র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী জানান, হামলার আগে ও পরে ফয়সলের সঙ্গে তাঁদের একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁদের সম্পৃক্ততা যাচাইয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

এর মধ্যেই আল-জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের দাবি করেছেন, হামলার শুটার ফয়সল করিম মাসুদ ও তাঁর সহযোগী আলমগীর হোসেন বর্তমানে ভারতের আসামের গুয়াহাটিতে অবস্থান করছেন। সায়ের তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে জানান, সীমান্ত পার হওয়ার পর জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মাসুদুর রহমান বিপ্লব ফয়সলকে একটি ভারতীয় সিম কার্ড সংগ্রহ করে দেন।

সেই নম্বর ব্যবহার করে ফয়সল ঘনিষ্ঠ মহলে নিজের উপস্থিতির কথা জানান দেন বলে দাবি করা হয়। সায়ের আরও বলেন, ওই ভারতীয় নম্বর থেকে পাঠানো একটি সেলফি ইন্টারসেপ্ট করা হয়েছে, যা আসামের গুয়াহাটিতে তোলা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার এই ঘটনায় রাজনৈতিক সহিংসতা, সীমান্তপথে পলায়ন এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের অভিযোগ সামনে আসায় বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রশ্নটা এখন আর কে গুলি করল—সেটায় সীমাবদ্ধ নেই। আসল প্রশ্ন, হাদীর শ্যুটাররা কি সত্যিই নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়তে পেরেছে? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে এটি কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়াবহ ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি নয়? তফসীল পরবর্তী সময়ে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি, সমন্বয় ও আগাম সতর্কতার কতটা ঘাটতি ছিল সেটাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।