নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শাহজাহান রোডের একটি ফ্ল্যাটে গৃহিণী মালাইলা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজকে (১৫) হত্যার পর ঘাতক গৃহকর্মী আয়েশা (২৩) ঘটনাস্থলের বাথরুমেই গোসল করে নিজের শরীরের রক্ত মুছে ফেলেছে। এরপর নাফিসার স্কুল ইউনিফর্ম পরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নির্বিঘ্নে ভবন ছেড়ে যায় সে।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে ৩২/২/এ ভবনের সপ্তম তলার ৭/বি নম্বর ফ্ল্যাটে ঘটে এ নির্মম হত্যাকাণ্ড।
পুলিশ জানায়, চার দিন আগে ভবনের দারোয়ান মালেকের মাধ্যমে আয়েশা নামের ওই তরুণীকে বাসায় আনা হয়। পরে মালাইলার সঙ্গে কথা বলে তাকে গৃহকর্মী হিসেবে রাখা হয়। হত্যার পর স্কুলড্রেস পরে বের হয়ে যাওয়ার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজেও ধরা পড়েছে।
ভবনের বাসিন্দারা জানান, মালাইলা আফরোজ গৃহিণী ছিলেন এবং তার মেয়ে নাফিসা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নাফিসার বাবা এম জেড আজিজুল ইসলাম উত্তরা সানবিমস স্কুলের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সকাল ৭টার দিকে নাফিসার বাবা বাসা থেকে স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে বোরকা পরিহিত আয়েশা লিফটে করে সাততলায় উঠে যায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে স্কুল ড্রেস, ব্যাগ ও মুখে মাস্ক পরে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ভবনের গেট পেরিয়ে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আজিজুল ইসলাম বাসায় ফিরে স্ত্রী ও মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান।
আজিজুল ইসলাম জানান, কয়েক দিন ধরেই গৃহকর্মীর প্রয়োজন ছিল তাদের। কাজের খোঁজে এক তরুণী আসলে দারোয়ান মালেক তাকে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দেন। মালাইলা তার সঙ্গে কথা বলে কাজে রাখেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, মেয়েটির নাম আয়েশা, বয়স প্রায় ২০, বাড়ি রংপুর। জেনেভা ক্যাম্পে চাচা-চাচির সঙ্গে থাকে বলে জানায় সে। বাবা-মা আগুনে পুড়ে মারা গেছে বলে দাবি করে এবং নিজের শরীরেও পোড়ার দাগ দেখায়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখা যায়, ফ্ল্যাটের প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে রক্তের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। আলমারি ও অন্যান্য আসবাবপত্র তছনছ অবস্থায় পাওয়া গেছে।
পুলিশের আরেক সূত্র জানায়, মা নিহত হওয়ার পর নাফিসা হয়তো ইন্টারকমের সাহায্যে সিকিউরিটিকে জানাতে চেয়েছিল, কিন্তু ইন্টারকম লাইন খোলা ছিল। আয়েশা ঠান্ডা মাথায় দুজনকে হত্যা করে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে এবং পালানোর আগে পরিকল্পিতভাবে স্কুলড্রেস পরে নেয়। বাথরুম থেকে একটি সুইচ গিয়ারসহ দুটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ, যেগুলো দিয়েই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা।
ঘটনার পর দারোয়ান মালেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ইবনে মিজান জানান, খবর পেয়ে পুলিশ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে। আহত অবস্থায় নাফিসাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তের জন্য দুই লাশ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য মিলেছে, সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজে হত্যার আগে ও পরে গৃহকর্মীর গতিবিধি বিশ্লেষণ করে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হবে।”
পুলিশ আরও জানায়, বাসায় ধস্তাধস্তির স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে, দেয়াল-মেঝেতে রক্তের দাগ দেখা গেছে। আলমারি ও ব্যাগ তছনছ অবস্থায় থাকায় ধারণা করা হচ্ছে কিছু জিনিসপত্র নিখোঁজ হতে পারে। সিসিটিভিতে আপাতত একজনকেই দেখা গেলেও আশপাশে কেউ সম্পৃক্ত ছিল কি না তা তদন্তে দেখা হবে।
ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি ধারালো ছুরিই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে বলে পুলিশ মনে করছে, এবং বাথরুমে গোসলের প্রমাণ মিলেছে বলে জানান তদন্তকারীরা।