বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১২ সফর, ১৪৪৭ হিজরি

রয়টার্সের প্রতিবেদন : ট্রাম্পকে উপেক্ষা করেই যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন পুতিন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান, যতক্ষণ না পশ্চিমা দেশগুলো তার শর্তে শান্তি আলোচনায় বসে। ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্রের বরাত দিয়ে এমনটাই জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিতেও বিচলিত নন রুশ প্রেসিডেন্ট। বরং রুশ বাহিনী যত অগ্রসর হচ্ছে, ততই রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের পরিধি বাড়তে পারে।

পুতিন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সেনা পাঠান, যা ছিল পূর্ব ইউক্রেনে রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় বাহিনীর দীর্ঘ আট বছরের সংঘাতের এক চরম পরিণতি।

সূত্রমতে, পুতিন মনে করেন, রাশিয়ার অর্থনীতি ও সেনাবাহিনী এখন এতটাই শক্তিশালী যে, অতিরিক্ত যে কোনো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা তার দেশ সহ্য করতে পারবে।

এর আগে, ট্রাম্প সোমবার ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ নতুন অস্ত্র সহায়তার ঘোষণা দেন এবং বলেন, ৫০ দিনের মধ্যে শান্তিচুক্তি না হলে রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।

ওই তিনটি সূত্র জানিয়েছে, পুতিন বিশ্বাস করেন যে পশ্চিমা দেশগুলো এখনো শান্তির মৌলিক দিকগুলো নিয়ে তার সঙ্গে গঠনমূলকভাবে আলোচনা শুরু করেনি। ফলে তিনি যুদ্ধ থামাবেন না, যতক্ষণ না তার চাওয়া পূরণ হয়।

একটি সূত্র বলেন, ‘পুতিন মনে করেন, এখনো কেউ ইউক্রেনে শান্তি নিয়ে তার সঙ্গে গুরুত্বসহকারে কথা বলেনি— এমনকি আমেরিকাও না। তাই তিনি তার লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।’

সূত্রটি জানায়, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একাধিকবার ফোনালাপ হয়েছে। মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফও রাশিয়া সফর করেছেন। তবু পুতিন মনে করেন, এখনো প্রকৃত কোনো শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়নি।

আরেকটি সূত্র মতে, ‘পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ককে মূল্য দেন এবং উইটকফের সঙ্গে ভালো আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার স্বার্থ সবার ওপরে।’

হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া :

এদিকে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি বলেছেন, ‘বাইডেন যুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হত্যাযজ্ঞ বন্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পুতিন যদি যুদ্ধ থামাতে রাজি না হন, তাহলে তাকে কড়া নিষেধাজ্ঞা ও শুল্কের মুখে পড়তে হবে।’

পুতিনের শান্তির শর্ত:

· ন্যাটো আর পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হবে না — এমন আইনি অঙ্গীকার;

· ইউক্রেন নিরপেক্ষ থাকবে এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় সীমা থাকবে;

· রুশভাষীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে;

· রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

পুতিন ইউক্রেনের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। তবে তা কীভাবে কার্যকর হবে, তা এখনো পরিস্কার নয়।

এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এরই মধ্যে বলেছেন, ইউক্রেন কখনো রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেবে না এবং ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার অধিকার তাদের সার্বভৌম অধিকার।

‘ইউক্রেন দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে’:

অন্য একটি সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকিকে পাত্তা না দিয়ে পুতিন ইউক্রেনে তার সামরিক লক্ষ্য অর্জন করাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। এমনকি চীন বা ভারত রাশিয়ার তেল কিনলে তাদের ওপর মার্কিন শুল্ক চাপিয়ে দিলেও রাশিয়া বিকল্প পথ খুঁজে নেবে।

সূত্র মতে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর চেয়েও বেশি গোলাবারুদ উৎপাদন করছে।

অন্যদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া ইউক্রেনে প্রায় ১,৪১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে।

এখন তারা:

· ক্রিমিয়া (২০১৪ সালে দখল);

· লুহানস্কের পুরোটা;

· দোনেৎস্ক, জাপোরিঝিয়া, খেরসনের ৭০%-এর বেশি;

· খারকিভ, সুমি, ডিনিপ্রোপেট্রোভস্কের অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণ করছে।

পুতিনের মতে, এই পাঁচটি অঞ্চল এখন রাশিয়ার অংশ এবং কিয়েভকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। অন্যথায় শান্তি সম্ভব নয়।

আসতে পারে আরও আগ্রাসন :

তৃতীয় সূত্রটি বলেন, ‘যুদ্ধ থামবে না। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়লে রাশিয়ার আঞ্চলিক দাবি আরও বাড়বে।’

তিনি জানান, যদি ইউক্রেন বেশি প্রতিরোধ করে, তবে রাশিয়া কেবল পূর্বাঞ্চলে থেমে যেতে পারে। তবে ইউক্রেন দুর্বল হলে ডিনিপ্রোপেট্রোভস্ক, সুমি ও খারকিভ-এর দিকেও রাশিয়া এগোতে পারে।

জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার গ্রীষ্মকালীন অভিযান প্রত্যাশামতো সফল হয়নি। যদিও কিয়েভ স্বীকার করেছে, রাশিয়ার সৈন্যসংখ্যা বেশি, তবু তারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

ট্রাম্প বনাম পুতিন :

আমেরিকার মতে, এ যুদ্ধেই ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি (১২ লাখ মানুষ হতাহত)। যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়েই ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব দেয় না।

দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফেরার পর ট্রাম্প অন্তত ছয়বার পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। সোমবার তিনি বলেন, ‘পুতিন কোনো আততায়ী নন, তবে তিনি একজন কঠিন মানুষ।’

বাইডেন প্রশাসন যেখানে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে নেওয়ার কথা বলেছিল, সেখানে ট্রাম্প প্রশাসন তা থেকে সরে এসেছে এবং ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতির ভাবনাও প্রকাশ করেছে।

পুতিন এ যুদ্ধকে রাশিয়া-পশ্চিম সম্পর্কের মোড় ঘোরানো অধ্যায় বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে অপমান করেছে, ন্যাটো বাড়িয়ে তাদের প্রভাব বলয়ে হস্তক্ষেপ করেছে।

শান্তি প্রস্তাব ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা :

পুতিন এখনো ট্রাম্পের শর্তহীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সাড়া দেননি, যদিও কিয়েভ তাতে সম্মতি দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিগত কয়েক দিনে রাশিয়া শত শত ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনীয় শহরে হামলা চালিয়েছে।

তবে ট্রাম্প মঙ্গলবার বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পুতিনের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়নি, ইউক্রেন সংকটের সমাধান এখনো সম্ভব।

একটি সূত্র বলেন, উইটকফের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা হলেও তা পূর্ণাঙ্গ শান্তি পরিকল্পনায় রূপ নেয়নি। অন্যদিকে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, রাশিয়ার ওপর ১০০% শুল্ক আরোপ ও রুশ পণ্য কেনে এমন দেশগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞার চিন্তা করা হচ্ছে।

যদিও রাশিয়ার ওপর এতদিনের নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধের খরচ সত্ত্বেও, রাশিয়ার অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করছে। ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৩% এবং ২০২৫ সালে ২.৫% প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে।

সূত্রমতে, ট্রাম্পের ওপর পুতিনের খুব একটা নির্ভরতা নেই এবং পুতিন বোঝেন, ট্রাম্প একজন অপ্রত্যাশিত নেতা, যার কাছ থেকে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তাই তিনি ট্রাম্পকে বিরক্ত না করেই নিজের কৌশল চালিয়ে যাচ্ছেন।

একটি সূত্র শেষ কথায় বলেছে, ‘আগামী মাসগুলোতে উত্তেজনা বাড়বে এবং বিশ্বের দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। আর এই যুদ্ধ চলতেই থাকবে।’