মুক্তবাণী ডেস্ক: ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়ে ড্রোন ব্যবহারের নির্দেশ দেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের হত্যার উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে শেখ হাসিনার গত বছরের ১৮ জুলাই টেলিফোনে কথোপকথনে এ নির্দেশের বিষয়টি উন্মোচিত হয়। একইসঙ্গে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনও আদালতে শোনানো হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ অভিমত ব্যক্ত করেছে।
রায়ে বলা হয়েছে, কথোপকথন সংক্রান্ত পেনড্রাইভ ও সিডি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা শেষে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, কথোপকথন প্রকৃত এবং জাল বা কৃত্রিম নয়। আদালত কক্ষে এসব কথোপকথন শোনানো হয় এবং তা সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সোমবার এ রায় ঘোষণা করে। রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। আরেক আসামি সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরস্পর যোগসাজশে নৃশংসতা ঘটান। মামুনের সাক্ষ্যে উঠে আসে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত সচিব, এসবি প্রধান, ডিবি প্রধান, র্যাব মহাপরিচালক, ঢাকা মহানগর কমিশনার, বিজিবি ও আনসারের মহাপরিচালক, এনটিএমসি প্রধান, ডিজিএফআই ও এনএসআই প্রধান সমন্বয়ে একটি কোর কমিটি গঠিত হয়।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর প্রতিরাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক হতো। শেখ হাসিনার কাছ থেকে নির্দেশনা আসত কোর কমিটির কাছে। মামুন জানান, আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়ে ড্রোন ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। শেখ হাসিনা নিজেই লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশ দেন। অতিরিক্ত ডিআইজি জোয়ারদার এ সময় উপস্থিত ছিলেন এবং বার্তাটি সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়।
রায়ে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত তিনজন যৌথভাবে নেতৃত্ব দেন- জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ হিসেবে। শেখ হাসিনার আদেশের পাশাপাশি আসাদুজ্জামান খান ও মামুনের তত্ত্বাবধানে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সারা দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ চালায়। হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের ফলে প্রায় ১,৫০০ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জন এবং আশুলিয়ায় আরও ছয়জন আন্দোলনকারী ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাকসুদ কামালের সঙ্গে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার কথোপকথন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তাতে তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকার আখ্যা দিয়ে বলেন, “রাজাকারদের তো ফাঁসি দিয়েছি, এবার তোদেরও তাই করব।” রায়ে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য তাঁর দলের কর্মী ও সহযোগী সংগঠনকে প্ররোচিত করেছে এবং আন্দোলনকারীদের হত্যার আদেশে পরিণত হয়েছে।
রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের দাবি শোনার পরিবর্তে আন্দোলনকে অবমূল্যায়ন করেন এবং অবমাননাকর মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা চাকরি পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে।” এ মন্তব্যে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হয় এবং মন্তব্য প্রত্যাহার ও ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়।