রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তারিখ ধরে প্রায় ৬০ দিন সময় রেখে তফসিল ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
এ ব্যাপারে দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট না হলেও ইসির হিসাবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হতে পারে তফসিল ঘোষণা।
রাজনৈতিক দলগুলোও তফসিলের তারিখ জানাতে তাগাদা দিয়ে আসছে। তাতে সাড়া দিয়ে সপ্তাহখানেক পরেই তফসিলের দিন ঘোষণার ‘সম্ভাবনা রয়েছে’ কমিশনের।
অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন দ্বিতীয়বার বসছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সমন্বয় নিয়ে। সংসদ নির্বাচনের তফসিল প্রস্তুতির মধ্যে গণভোটের অধ্যাদেশের জন্যও অপেক্ষায় রয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে এই গণভোটের জন্য তিন-চার দিনের মধ্যে আইন করে ফেলার কথা বৃহস্পতিবার তুলে ধরেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
নির্বাচনকে সামনে রেখে আরেক দফা আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ও আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে এএএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এ মাসের শেষে নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন পরিকল্পনা ও মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ের কাজ সেরে প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবে কমিশন। এরপর তফসিল নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
কেন্দ্রীয় সমন্বয় সেল
সংলাপ শেষ করে বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে অন্য কমিশনার, ইসি সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে একটা বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে নির্বাচন সামনে রেখে একজন নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে ‘আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্রীয় সমন্বয় সেল’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
এ সেল নির্বাচন ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য, গুজব, এআইয়ের অপব্যবহার, ভুয়া খবর, অপপ্রচার রোধে ব্যবস্থা নেবে এবং সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে সঠিক তথ্য সরবরাহে দ্রুত উদ্যোগ নেবে।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আইনশৃঙ্খলা, মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরশেন, এআই ক্রিয়েটেডে অপপ্রচার-এসব নিয়ে আমাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিভাগ, জেলা, উপজেলা লেভেলে যেন কো-অর্ডিনেশন করতে পারি। আইনশৃঙ্খলার বিষয় রয়েছে। একটা সেল হবে, যেখান থেকে ম্যানেজ করা হবে। কো-অর্ডিনেশন করা হবে-প্রস্তুতিমূলক আলোচনা।”
সবশেষ ২০ অক্টোবর আইন শৃঙ্খলা সভা হয়েছে এবং ৩০ আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। সেখানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এসেছে, যা পর্যালোচনা করে পরবর্তী সভায় সিদ্ধান্তমূলক নির্দেশনা দেবে আগামীর বৈঠকে।
এ ব্যাপারে ইসি সচিব বলেন, “আরও দুটো বৈঠক হবে।…আগের বৈঠকের ধারাবাহিকতায় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেবে ইসি।”
নির্বাচন পরিচালনা শাখা এবং জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ২৭ নভেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনামূলক বৈঠক করবেন সিইসি। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ বাহিনী প্রধান ও সংস্থা, বিভাগের প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ৩০ নভেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়োগ, পরিকল্পনা, সমন্বয় ও দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা করার সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগের প্রধানদের নিয়ে এ বৈঠক হবে।
এ দুই সভায় চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
ডিসেম্বরের কোন দিন তফসিল
সরকারের তরফ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন সুনির্দিষ্ট তারিখ জানিয়ে দেবে তফসিলে।
ভোট নিয়ে ‘শঙ্কা’ কাটাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে তফসিল ঘোষণার দাবিও উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত বৈঠকের পরে সেটি জানানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ দুটি সভার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে ডিসেম্বরে কোন তারিখে তফসিল ঘোষণা করবেন তা ঠিক করবেন সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনাররা।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “তফসিলের প্রস্তুতির বিষয়টি হচ্ছে, গণভোট হতে গেলে আইন হতে হয়। নির্বাচন কমিশনের কাছে আইনের মাধ্যমে এখতিয়ারটা আসতে হয়। আমরা গণভোটের আইনের অপেক্ষায় রয়েছি।…আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে তফসিলের সময়টায় (তফসিল থেকে ভোটের তারিখ) দুই মাসের গ্যাপ রাখা।”
নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একই দিনে ভোট করবে। দুটো ব্যালট হবে এবং ভিন্ন রঙের হবে। গণভোট অধ্যাদেশ হাতে না পেলে এসব বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরবে ইসি।
এক নজরে তফসিলগুলো
| সংসদ নির্বাচন | তফসিল ঘোষণার তারিখ | ভোটের তারিখ | তফসিল ঘোষণা থেকেভোট পর্যন্ত সময় | ভোটের দিন |
| প্রথম | ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি | ৭ মার্চ | ৬০ দিন | বুধবার |
| দ্বিতীয় | ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর | ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি (পুনঃতফসিল) | ৫৪ দিন | রোববার |
| তৃতীয় | ১৯৮৬ সালের ২ মার্চ | ৭ মে | ৪৭ দিন | বুধবার |
| চতুর্থ | ১৯৮৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর | ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ | ৬৯ দিন | বৃহস্পতিবার |
| পঞ্চম | ১৯৯০ সালের ১৫ ডিসেম্বর | ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি | ৭৮ দিন | বুধবার |
| ষষ্ঠ | ১৯৯৫ সালের ৩ ডিসেম্বর | ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (পুনঃতফসিল) | ৫৫ দিন | বৃহস্পতিবার |
| সপ্তম | ১৯৯৬ সালের ২৭ এপ্রিল | ১২ জুন | ৪৭ দিন | বুধবার |
| অষ্টম | ২০০১ সালের ১৯ অগাস্ট | ১ অক্টোবর | ৪২ দিন | সোমবার |
| নবম | ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর | ২৯ ডিসেম্বর (পুনঃতফসিল) | ৪৭ দিন | সোমবার |
| দশম | ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর | ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি | ৪২ দিন | রোববার |
| একাদশ | ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর | ৩০ ডিসেম্বর (পুনঃতফসিল) | ৪৬ দিন | রোববার |
| দ্বাদশ | ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর | ৭ জানুয়ারি | ৫৩ দিন | রোববার |
২০০৮ সালে দলের নিবন্ধন প্রথা চালুর সময় ৩৮টি দল ছিল। বর্তমানে তা ৫৫ টিতে দাঁড়িয়েছে; একটির নিবন্ধন স্থগিত ও তিনটির নিবন্ধন বাতিল রয়েছে।
প্রথম সংসদ নির্বাচনে ১৪টি দল অংশ নেয়। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯ দল, তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮টি দল; চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে মাত্র আটটি দল অংশ নিয়েছিল। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৭৫টি দল অংশ নেয়।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে তফসিল দিয়ে তিনবার পরিবর্তন করতে হয়। অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে এতে অংশ নেয় ৪১টি দল।সপ্তম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৮১টি দল আর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৫৪টি দল অংশ নেয়।
নবম সংসদের সময় ভোটে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয় আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিজ এলাকার ১% সমর্থন দেখাতে হয়। নিবন্ধিতরা দলীয়ভাবে ভোট করার সুযোগ পায় আর স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা হয়। নবম সংসদ নির্বাচনে কেবল নিবন্ধিত ৩৮টি দল অংশ নেয়।
দশম সংসদ নির্বাচনে দল অংশ নেয় ১২টি। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করে এবং ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড হয়।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩৯টি দল ভোটে অংশ নেয়। সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৮টি দল ভোটে অংশ নেয়। এসময় নিবন্ধিত দল ছিল ৪০টি।
এবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত দল রয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৫৫টি। নির্বাচন কমিশন অবশ্য সংলাপে ডেকেছে ৪৮টি দলকে। আর আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত থাকায় প্রথমবারের মত ভোটে অংশ নিতে পারবে না।