রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০ ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২১ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

সুসময়েও অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুুখি বিএনপি

এম আবদুল্লাহ
এক সময় ম্যাগাজিনের বেশ কদর ছিল। সপ্তাহান্তে প্রকাশিত বিভিন্ন ম্যাগাজিনের প্রচুর পাঠক ছিল, প্রভাবও ছিল। ব্যক্তিগত আর্কাইভ হাতড়াতে গিয়ে ইত্তেফাক গ্রুপের সাপ্তাহিক ‘রোববার’-এর একটি কপি সামনে আসলো। ১৯৮১ সালের ৫ জুলাই প্রকাশিত। কভার স্টোরি বা প্রচ্ছদ রচনার শিরোনাম ছিল- ‘বিলুপ্তির পথে বিএনপি?’। ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিপদগামী একদল সেনা সদেস্যের হাতে শাহাদাৎ বরণের ৩৫ দিনের মাথায় এ কভার স্টোরি করেছিল সাপ্তাহিকটি। তাতে নানা যুক্তি ও সমীকরণ তুলে ধরে বলার চেষ্টা হয়েছিল যে, প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে বিএনপি টিকবে না। সে ভবিষ্যদ্বানী ভুল প্রমানিত হয়েছিল অচিরেই। তিন বছরেরও কম বয়েসী শিশু বিএনপি শুধু টিকেই যায়নি, গৃহবধু বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ়চেতা, নিরাপস ও দূরদর্শী নেতৃত্বে এগিয়েছে দুর্দান্ত গতিতে। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধ লড়াই করে এক দশকের মাথায় ১৯৯১ সালে বিপুল সমর্থন নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল।
বিএনপি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, বিলীন হয়ে যাবে, মুসলিম লীগ হয়ে যাবে, বিএনপি’র নেতা কে, ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন- এমন আওয়াজ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। ওয়ান-ইলেভেনের পরতো খালেদা জিয়াকেই মাইনাস করে দলকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলার দূরভিসন্ধি হয়েছিল। অনেকে দলটির ভবিষ্যৎ নেই বলে তাচ্ছিল্যভরে হরেক রকম মন্তব্য করেছিলেন, দিস্তায় দিস্তায় লিখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো শহীদ জিয়া প্রতিষ্ঠিত দলটি টিকে আছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই, উত্থান-পতন আর ভাঙ্গা-গড়ার খেলা মোকাবিলা করে।
পয়লা সেপ্টেম্বর সাতচল্লিশে পা দিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। পূর্ণ যৌবনে উপনীত হয়েছে। ১৯৭৮ সালের এই দিনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ মধ্যপন্থী এই রাজনৈতিক দলটির। চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি এমন একটি সময়ে সাতচল্লিশে পা রাখছে, যখন দীর্ঘ দেড় যুগের ঘোর অমানিষা কাটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতছানি দিচ্ছে। স্বস্তির শ্বাস নিতে পারছে। এক বছর আগে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় এক অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়নের পর ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
দেড় যুগ ধরে বলতে গেলে সবকিছুই ছিলো বিএনপি’র প্রতিকূলে। ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনাসমর্থিক শাসনে পর্যুদস্ত হয়। ২০০৮ সালের মইন-ফখরুদ্দিনদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়ায় পাতানো নির্বাচনে ভরাডুবির মুখোমুখি হতে হয়। তার পর অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতন ও নিঃশেষ করে দিতে রাষ্ট্রীয় স্বৈরশক্তির সর্বাত্মক আয়োজন চলেছে। ২০১৩ সালের বর্জিত ভোটারবিহনী নির্বাচন, ২০১৮ সালের নিশিভোট আর ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতার চৌহদ্দি থেকে অনেক দূরে চলে যায়। নেতাকর্মীরা অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত ও হতোদ্যম হয়ে পড়েন। খোদ শীর্ষ পর্যায়েই হতাশার ছায়া পড়তে দেখা যায়।
চব্বিশের ৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে অন্য অনেকের মতো বিএনপিও কিছু সুবিধা ইতোমধ্যে পেয়েছে। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিধি-নিষেধের শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছেন। কারাবন্দী নেতারা মুক্তি পেয়েছেন। নিপীড়নমূলক মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে-হচ্ছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেওয়া ফরমায়েশি সাজার রায়গুলো বাতিল হয়েছে। তাঁর বক্তব্য প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠেছে। মিডিয়ায় প্রাপ্য প্রচারসুবিধা পাচ্ছে। প্রশাসনেও বিএনপি’র মতাদের্শর অনেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। বুকভরে শ্বাস নিতে পারছেন দলের নির্যাতিত নেতা-কর্মীরা। বাসা-বাড়িতে ঘুমোতে পারছেন। মামলার জালে আটকে তছনছ হয়ে যাওয়া লাখো জাতীয়বাদী পরিবারে স্বস্তির সুবাতাস বইছে।
টানা প্রায় ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ও জিয়া পরিবার এখনও বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্খার কেন্দ্রে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কালজয়ী জাতীয়তাবাদী আদর্শ আর উন্নয়ন, উৎপাদন ও জনগণতান্ত্রিক রাজনীতিই বিএনপির মূল শক্তি। সে আদর্শ থেকে খানিকটা বিচ্যুতি ঘটেছে- এমন অভিযোগ ও আক্ষেপ করছেন দলটির কোন কোন শুভাকাঙ্খী। ‘দেশ মৌলবাদের অভয়ারণ্য’ হওয়ার শঙ্কা কিংবা অতিমাত্রায় বাম-প্রেম ভুল বার্তা দিচ্ছে। যদিও বিএনপির নীতি-নির্ধারকেরা আদর্শিক বিচ্যুতির অভিযোগ কবুল করতে নারাজ।
গেল বছরে ছাত্র-জনতার অভাবনীয় অভ্যুত্থানের আগে বাংলাদেশের অবস্থা যেমনটা ছিলো, ঠিক তেমনি প্রায় পাঁচ দশক আগে পঁচাত্তরের আগস্টে বিপ্লবপূর্ব দেশে ছিলো ব্যাপক দুর্নীতি, অরাজকতা ও অস্থিরতা। হতাশা, ক্ষোভ, বঞ্চনা আর সীমাহীন বৈষম্য গ্রাস করেছিলো। একদলীয় দুঃশাসনে পিষ্ঠ-অতিষ্ঠ জনগণের দম-বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি এক দলীয় বাকশালী শাসন কায়েমের পর রুদ্ধ হয়েছিলো বহুদলীয় গণতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পথ। যেমনটি হয়েছিলো সদ্য-পতিত শেখ হাসিনা সরকারের তিন মেয়াদেও। পচাত্তরের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে অভাবনীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে।
তার পর ৩ নভেম্বর প্রতিবিপ্লব ও তার ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির সূচনা। সেদিন সিপাহী জনতার মিলিত সমর্থনে স্বাধীনতার ঘোষক ও অকূতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান বীর উত্তম দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। তখন দেশের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। দুর্দান্ত সাহসিকতায় ভর করে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুজ্জ্বল রেখে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। আর তখন দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন পড়ে একটি প্লাটফর্মের।
এ প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রমনা জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনকে দ্রুত অসামরিকীকরণের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা কর্মসুচি ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে করা হয় এ দলের আহবায়ক। জাগদল গঠনের পর একই বছর ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ১৩ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীকে হারিয়ে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পরই জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বিলুপ্তি ঘটে জাগদল ও ঐক্যফ্রন্টের। ঘোষিত ১৯ দফাকেই নবগঠিত বিএনপি’র মূল আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। জিয়াউর রহমান প্রথমে দলের আহবায়ক ও পরে চেয়ারম্যান হন। প্রথম মহাসচিব হন অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
মুক্তদ্বার নীতি গ্রহণ করে দলকে ব্যাপকভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী প্লাটফর্ম হিসেবে রূপ দিতে জিয়াউর রহমান দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী মতাদর্শের রাজনীতিকদের স্বাগত জানান। তখন দলের ৪৫ শতাংশেরও বেশী নেতাকর্মী ও সদস্য ছিলেন রাজনীতিতে নবাগত ও তরুণ। দলের প্রধান লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়- অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য ও জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার চেতনা সৃষ্টি। পাশাপাশি চারটি মূলনীতি ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাকালে গোটা জাতি ছিল বিভক্ত। আর এই বিভক্তি ডান, মধ্য ও বাম ইত্যাকার রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতেই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে বা করেনি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বা বিপক্ষ শক্তি হিসেবেও। ফলে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিসেবীর মতো সামাজিক শক্তিগুলোও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আমলা এমনকি সামরিক বাহিনীও মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিএনপি গঠনের প্রধান লক্ষ্য ছিল এ বিভাজন দূরীকরণ এবং গোটা জাতি যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একক সত্ত্বা হিসেবে কাজ করতে পারে সেজন্য বিবদমান গোষ্ঠী ও উপদলের একত্রিকরণ। জিয়াউর রহমান শুধু তার প্রতিষ্ঠিত দল নয়, বাকশালের কারণে বিলীন হয়ে যাওয়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রকাশ্যে রাজনীতির সুযোগ করে দেন। বিলুপ্ত হওয়া আওয়ামী লীগকেও নিজ নামে রাজনীতি করার পথ সুগম করে দেন।
আজন্ম বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই পথ চলতে হয়েছে বিএনপিকে। দল গঠনের মাত্র দু’বছরের মাথায় কতিপয় দেশদ্রোহী বিপথগামী সেনাদের হাতে প্রাণ দিতে হয় ইতিহাসের সফল ও নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানকে। তার পর দলের হাল ধরেন গৃহবধু বেগম খালেদা জিয়া। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত লড়াইয়ে আপসহীন ভাবমুর্তি গড়ে ওঠে তাঁর। নব্বইতে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী হয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারে নেতৃত্ব দেন। বস্তুতঃ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অপরিমেয় দেশপ্রেম কাল হয়েছে দলটির। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দু’মেয়াদে ক্ষমতায় গিয়ে দেশের উন্নয়নে যেমন অবদান রেখেছে বিএনপি, তেমনি দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে বিপর্যয়ের মুখেও পড়েছে বার বার।
তবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি’র সামনে চ্যালেঞ্জগুলো অভিনব ও অভূতপূর্ব। যে কয়টি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে সেগুলোর সঙ্গে এবারের নির্বাচনের ঢের তফাৎ রয়েছে। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট বিএনপি’র ধানের শীষে ভোট পড়েছে। বিএনপি’র রাজনীতির সাথে যুক্ত নয় এমন ভোটাররাও আওয়ামী লীগ ঠেকাতে বিএনপিকে বেচে নিয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে শহীদ জিয়ার দল। ১৯৯৬ সালে জয় না পেলেও ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হতে পেরেছিল। সামনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থাকছে না। ফলে কাছাকাছি মতাদের্শের বিকল্প থাকছে ভোটারদের সামনে। এবার দলের নেতাকর্মীদের বাইরের পপুলার ভোট টানতে বিএনপিকে প্রমাণ করতে হবে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী মতাদর্শের রাজনীতিতে তারাই শ্রেষ্ট্য ও নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ এবার প্রায় সম-মতাদর্শের বিকল্প রয়েছে ভোটারের সামনে।
আওয়ামী লীগ স্বনামে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও তাদের ভোট কোন বাক্সে যায় এবং ভোটের বাক্সে তার কী প্রভাব পড়ে, সেটিও বিএনপি’র সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এছাড়া দেড় দশক ধরে ভোট দিতে না পারা প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ ভোটার কী করবে সেটাও অজানা। নির্বাচনী ব্যবস্থা তছনছ হয়ে যাওয়ায় ভোটের মানচিত্র বর্তমানে কেমন রূপ নিয়েছে তা কারও জানা নেই। বিভিন্ন জরিপ বলছে, প্রায় অর্ধেক ভোটার মন খুলে বলছেন না, আগামী নির্বাচনে কাদের ভোট দেবেন তারা। ফলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন যে অতীতের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জের তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিষয়টি এরই মধ্যে অনুধাবন করেছেন। বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেছেন- ‘আগামী নির্বাচন যতটা সহজ হবে ভাবছেন, ততটা সহজ নয়’।
প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগমুক্ত রাজনীতিতেও বিএনপি’র পথ একেবারে কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক রাজনীতিতে হাল ধরবেন এমন আশা ছিল অনেকের মনে। কিন্তু ঢাকায় ও লণ্ডনে চিকিৎসার পরও রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়ার সক্রিয়তা প্রত্যাশার চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। সাজা ও মামলার খড়গ থেকে এরই মধ্যে মুক্ত হয়েছেন দলের বর্তমান প্রাণপুরুষ নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর দেশে ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে অগনিত নেতাকর্মী। কিন্তু নিরাপত্তাসহ নানা জটিল সমীকরণে তিনি এখনও বিলাত প্রবাসী। আশা করা হচ্ছে ডিসেম্বরের শুরুতে নির্বাচনী তফশিল ঘোষণার আগেই দেশে ফিরে আসবেন তারেক রহমান।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে অনুকূল ময়দান পেলেও নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা, সংশয় বিএনপিকে আশা-নিরাশায় দোলায় দোলাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ, পতিত হাসিনা সরকারের নিপীড়নমূলক মামলা ও সাজার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, জনআকাঙ্খার আলোকে রাষ্ট্র সংস্কারের ধরন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপিকে নানা ধরনের চাপ সামলাতে হচ্ছে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ায়। টানাপড়েনও হয়েছে সময়ে সময়ে। লণ্ডনে ড. ইউনূস-তারেক বৈঠক ও যৌথ ঘোষণায় বরফ গললেও অজানা নানা আশঙ্কা এখন বিএনপিকে তাড়া করছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হলেও সরকারের মধ্যেই একটি অংশ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে বলে খোলামেলা অভিযোগ করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দীর্ঘ স্বৈরশাসনে নিপীড়িত, বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের সামলে রাখার কঠিন কাজটি করতে গিয়ে গত বছরজুড়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। পাঁচ হাজারের অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এত কম সময়ে এত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো অপ্রিয় কাজটি নেতৃত্বের কাছে অত সহজ ছিল না। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিজেদের অবস্থান নিয়েও মাঝেমাঝে দোলাচলে পড়তে হচ্ছে দলটিকে। আবার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযাত্রী জামায়াতের নব-উত্থানও স্নায়ু চাপ বাড়িয়েছে। নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশে অস্থিরতা বাড়ছে। একের পর এক অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন ও টেকসই গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়াকে চোখ রাঙাচ্ছে দেশি-বিদেশী অশুভ শক্তি। এসব ক্ষেত্রে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, উদারনীতি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলে পাতের ভাতে ছাই পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না। দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে না পারলে পথ চলা আবারও কন্টকাকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

এম আবদুল্লাহ : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক।