রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

১০ ভুলে শুরুতেই পর্যদুস্ত ইরান

এফ শাহজাহান ॥

ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোতে শুক্রবার ভোরে দুই শতাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। জবাবে দুপুরে শতাধিক ড্রোন দিয়ে তেল আবিবে পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান।

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরিও, ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান কমান্ডার হুসেইন সালামি এবং দুই জন উর্ধ্বতন পরমাণু বিজ্ঞানীসহ সামরিক বাহিনীর অনেকেই শহীদ হয়েছেন।

পক্ষান্তরে আগে থেকেই সতর্ক থাকায় ইরানের ড্রোন হামলায় ইসরাইলের তেমন কোন ক্ষয়িক্ষতি হয়নি। ইরানের পাল্টা হামলার শঙ্কায় খাবার ও পানি মজুত করছে ইসরায়েলিরা। সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কায় দেশের চতুর্দিকে সেনা মোতায়েন করছে।

বিশ্বের মানবতাবাদী সব মানুষ চায়, মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরান জিতে যাক। কিন্তু বাস্তবে আজকের ইসরাইলী হামলায় ইরান একেবারে পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছে।

পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষ এবং মুসলিম উম্মাহর আকুণ্ঠ সমর্থন সত্বেও ইরান কী কারণে জায়নবাদীদের হাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে ? এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান এবং ইরানের ডিফেন্স উইকনেস নিয়েই আজকের এই ডিফেন্স অ্যানালাসিস।

ওয়ার স্ট্রাটেজিতে ইরান যে এতোটাই দুর্বল,সেটা কারো জানা ছিলো না আগে। অথচ প্রতিরক্ষা খাতে ইরান প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।

তবে বাৎসরিক সামরিক বাজেটে ইরানের তুলনায় ইসরাইলের ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাজেট ২৪৪০ কোটি ডলার। অন্যদিকে ইরানের বাজেট ৯৯৫ কোটি ডলার। ডিফেন্স র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের ১৪৫ দেশের মধ্যে ইরান ১৬তম অবস্থানে আর ইসরাইল ১৫ তম অবস্থানে রয়েছে।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সৈন্য সংখ্যায় ইসরাইলের চেয়ে বহু এগিয়ে আছে ইরান। ইরানের নিয়মিত সেনা যেখানে ১১ লাখ ৮০ হাজার সেখানে ইসরাইলের সৈন্য ৬ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ইরানের রিজার্ভ সৈন্য সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ আর ইসরাইলের রিজার্ভ সেনা আছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার।

ইরানের মোট সামরিক বিমানের সংখ্যা ৫৫১টি আর ইসরাইলের আছে ৬১২টি। এর মধ্যে ইরানের যুদ্ধ বিমান আছে ১৮৬টি আর ইসরাইলের যুদ্ধবিমান আছে ২৪১টি।

ইরানের অ্যাটাকিং বিমান সংখ্যা ২৩টি যেখানে ইসরাইলের আছে ৩৯টি। ইরানের পরিবহণ বিমান ৮৬টি ইসরাইলের ১২টি। ইরানের প্রশিক্ষণ বিমান ১০২টি আর ইসরাইলের ১৫৫টি।

ইরানের হেলিকপ্টার আছে ১২৯টি আর ইসরাইলের ১৪৬টি। ইসরাইলের ৪৮টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার আছে। ইরানের অ্যাটকিং হেলিকপ্টার ১৩টি।

ইসরাইলের ট্যাংক আছে ১৩৭০টি আর ইরানের ১৯৯৬টি। ইরানের সাঁজোয়া যান ৬৫ হাজার ৭৬৫টি আর ইসরাইলের ৪৩ হাজার ৪০৩টি।

সামরিক সক্ষমতায় ইসরাইলের চেয়ে কোন অনেকাংশেই এগিয়ে আছে ইরান। এর পাশাপাশি বিশ্ববাসীর সমর্থনও আছে ইরানের পক্ষে। এটাও যুদ্ধে জেতার একটা বড় সক্ষমতা।

এরপরেও আজকের ইসরাইলী হামলায় ইরানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান এবং ধ্বংসের ধরণ দেখেই বুঝা যাচ্ছে , ইরান পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছে।

ইরান-ইসরাইল সাম্প্রতীক সংঘাতে ইরান বেশ কিছু ভুল করার কারণেই ইসরাইলী হামলার শুরুতেই নান্তানাবুদ ও পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছে।

যে ১০ ভুলের কারণে যুদ্ধ শুরু না করতেই ইরান হেরে যাওয়ার মতো অবস্থায় পড়েছে এই প্রতিবেদনে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রথমত : ভুল প্রতিরক্ষা কৌশল
ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইহুদিবাদী ইসরায়েলের কাছ থেকে হাজার হাজার অত্যন্ত গোপন ও সংবেদনশীল নথি উদ্ধার করেছে বলে ইরান অযথা প্রচার চালিয়েছিলো। যার মধ্যে নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত ডিমোনা পারমাণবিক স্থাপনা সম্পর্কিত উচ্চমাত্রায় গোপনীয় তথ্যও রয়েছে বলে জানিয়েছিল ইরান।

ইসরাইলের স্পর্শকাতর এসব সামরিক তথ্য হাতে আসার পর এভাবে প্রচার চালানো ছিলো মারাত্মক ভুল প্রতিরক্ষা কৌশল।

দ্বিতীয়ত : প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও পুরনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
সোভিয়েত যুগের পুরোনো এয়ার ডিফেন্স ইরানের পরাজয়ের প্রধান কারণ।
ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূলভাগ এখনও রাশিয়া থেকে আমদানি করা S-200/S-300 ধরনের পুরনো সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে। এগুলো F-35 এর মতো স্টিলথ যুদ্ধবিমান বা অত্যাধুনিক ড্রোন শনাক্ত ও প্রতিহত করতে সক্ষম নয়। ইরানের রাডার ও বিদ্যুৎব্যবস্থা বিকল করতে সক্ষম হয়েছিল ইসরাইল।

বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে বা ইলেকট্রনিক জ্যামিং-এর পরিস্থিতিতে ইরানের রাডার কার্যকরভাবে কাজ করেনি।

তৃতীয়ত : বিস্ময়কর গোয়েন্দা ব্যর্থতা
ইরানের গোয়েন্দা দুর্বলতার কারণে ইসরায়েল নির্ভুলভাবে টার্গেট বেছে নিতে পেরেছে । একারনেই ইসরায়েলের হামলা ছিল একেবারে নির্ভুল ও অপ্রত্যাশিত।

পক্ষান্তরে এবিষয়ে ইরানের গোয়েন্দা ব্যর্থতা এতোটাই দুর্বল ছিল যে তারা এরকম স্পর্শকাতর সময়েও ঘুমিয়ে ছিল। ইরানের চরম নিরাপত্তা ফাঁকও ছিল। ইসরায়েল সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় আঘাত হেনেছে। এর মাধ্যমে ইসরাইল প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে যে তারা ইরানের সামরিক ঘাঁটি, ড্রোন ফ্যাক্টরি, পারমাণবিক গবেষণাগার সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য রাখছিল।

ইসরাইলী হামলা আসার আগেই ইরান সেইসব সিগন্যাল ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। আধুনিক গোয়েন্দা প্রযুক্তির ঘাটতি এখানে বড় কারণ বলে প্রমানিত হয়েছে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ ইরানের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। আগেও তারা বিজ্ঞানী হত্যা বা ড্রোন চুরির মতো কাজ করেছে। অথচ এবিষয়ে ইরান এবিষয়ে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে এবং সতর্কতামূলক কার্যকর কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি।

চতুর্থ : দুর্বল ডিফেন্স সিস্টেম
ইরান দাবি করে তাদের দেশীয় তৈরি “Bavar-373” বা “Khordad” সিস্টেম রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা ইসরায়েলের আক্রমণের সময় কার্যকর কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি।

পঞ্চমত : নীতিগত ভুল
আক্রমণ নয়, প্রতিশোধ”-ইরানের এই নীতিই ইরানকে এভাবে নাস্তানাবুদ করার সুযোগ দিয়েছে । ইরান দীর্ঘদিন ধরে ‘প্রতিশোধ নেব’ বা ‘যদি কেউ আঘাত করে তবে তার জবাব দেব’ এই কৌশল অনুসরণ করেছে। এতে করে তারা হামলা প্রতিহত করতে দেরি করে ফেলে।

ইসরাইল ফার্স্ট অ্যাটাকিং নীতি বা “preemptive strike” নীতি গ্রহণ করায় তারা আগেই প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে ফেলতে পেরেছে। পক্ষান্তরে ইরান প্রতিবার পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিতে দিতে বহু কৌশলগত সুযোগ হারিয়েছে।

ষষ্ট : সাইবার দুর্বলতা
ইরানের সাইবার সিস্টেম দুর্বল হওয়ার কারণে ইসরায়েল সাইবার হামলার মাধ্যমে ইরানের রাডার, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের গোলযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে অনেক এয়ার ডিফেন্স ইউনিট সময়মতো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। এটি ২০১০ সালের Stuxnet হামলার পর দ্বিতীয় বড় প্রমাণ। এরপরও ইরান এখনও সাইবার প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে পারেনি।

সপ্তম : কৌশলগত বিচ্ছিন্নতা ও বিভ্রান্তি
ইরানের প্রতিরক্ষা নীতিতে একটি বড় সমস্যা হলো তাদের সামরিক কাঠামো বহুস্তরবিশিষ্ট ও বিভক্ত। ইরানের Revolutionary Guards (IRGC) এবং Regular Military আলাদা আলাদা পরিচালিত হয়। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি কম এবং প্রতিক্রিয়া সমন্বিত নয় বলেই এখন প্রতীয়মান হচ্ছে। জরুরি পরিস্থিতিতে এই দুই সংস্থা একে অন্যের সাথে সময়মতো যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। একারনেও এবারের ইসরাইলী হামলার শুরুতেই সবচেয়ে বেশি নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে ইরান।

অষ্টম : অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস
ইরান নিজেদের সামর্থের তুলনায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভাষায় বড় বড় হুমকি দিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা দুর্বলতা আড়াল করেছিল, যা বাস্তবে টিকে থাকেনি। বড় বড় কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি ছিল না ইরানের।

নবম : আঞ্চলিক যুদ্ধ-প্রশিক্ষণের অভাব
ইরান দীর্ঘদিন হেজবোল্লাহ, হামাস, হুথিদের মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে এলেও সরাসরি রাষ্ট্রীয় যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা খুব কম ইরানের। পুরনো রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তারা ইসরায়েলের মতো একটি হাই-টেক, হাই-মবিলিটি, স্টিলথ-নির্ভর বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। সেটাই এবার ইরানের ব্যর্থতার আরেকটি বড় কারণ।

দশম : কাজে নয়,কথায় বিশ্বাসী
ইরান বহুদিন ধরে নিজেদের একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছিল, কিন্তু সেই অনুযায়ী তাদের প্রস্তুতি ছিলো না। এখন বাগযুদ্ধের দিন শেষ হয়ে গেছে, এটা হয়তো বুঝতে দেরি করে ফেলেছে ইরান। সেই কারণেই আজকের ইসরায়েলি হামলা ইরানের সেই ভাবমূর্তিকে গুরুতরভাবে আঘাত করে সফল হয়েছে।

ইসরাইলের আজকের হামলা ইরানকে একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি, গোয়েন্দা সক্ষমতা ও সাইবার প্রতিরক্ষা ছাড়া প্রতিপক্ষের সঙ্গে শক্তির লড়াইয়ে টিকে থাকা যায় না; সেটাই আবার প্রমানিত হয়েছে।