রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

৫ মে ২০১৩ : জনস্রোত ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ শাপলা চত্বরে নৃশংসতা চালায়

মুক্তবাণী অনলাইন : বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটি ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে তারা। সেই ধারাবাহিকতায় শাহবাগে গড়ে ওঠা ব্লগারদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে তাদের ফাঁসিসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের ডাক দেয় সংগঠনটি।

মহাসমাবেশে অংশ নিতে ওইদিন সুর্য ওঠার আগেই রাজধানীর প্রবেশ পথগুলো দিয়ে হেফাজত অনুসারীরা ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু র‌্যাব-পুলিশ তাদের ঢুকতে বাধ সাধে। কড়া নিরাপত্তা ব্যারিকেডে পড়ে প্রবেশপথগুলোতেই অবস্থান নেয় হেফাজতের সমর্থকরা। তবে সকাল ১০টার দিকে প্রবল জনস্রোতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বেরিকেড ভেঙে যায়। জনস্রোত ছুটতে থাকে শাপলা চত্বরের দিকে। জনস্রোত আসতে থাকে রাজধানীর বাবুবাজার ব্রিজ, যাত্রাবাড়ী সড়ক, বসিলা, গাবতলী ও মিরপুর দিয়ে। এছাড়াও, মানুষের স্রোত ছড়িয়ে পড়ে উত্তরা ও বাড্ডা-রামপুরা সড়কে।

হেফাজতের নেতাদের ভাষ্য, এই জনস্রোত সামলাতে না পেরে প্রশাসন ঘাবড়ে যায় এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে পুলিশ নিরীহ আলেমদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। সেই গুলি চলে পরদিন পর্যন্ত। আলেমদের রক্তের ওপর দিয়ে এবং শহিদের জীবনের বিনিময়ে সেই জনস্রোত শেষ হয়।

২০১৩ সালের ৫ মে, সকাল ১০টা। রাজধানীর পল্টন মোড়ে পুলিশের বিশাল বহর বায়তুল মোকাররমের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। গণমাধ্যমকর্মীরাও রয়েছেন সেখানে। মিনিট দশেকের মধ্যে শুরু হয় বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। সেই গুলিবর্ষণ এক নাগারে গিয়ে থামে সন্ধ্যা ৭টায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। রাতও গভীর হতে থাকে। তখন কানে ভেসে আসে-পুলিশ কঠোর হতে চলেছে। ওদিকে হেফাজত নেতাদের ঘোষণা তারা কোনোভাবেই শাপলা চত্বর ছাড়বে না। বাতাসে পোড়া গন্ধ। সেই গন্ধ অন্যকিছু নয়, বায়তুল মোকাররমের চারপাশে ইসলামী বইয়ের দোকান ও ফুটপাতে হকারদের ছোট ছোট দোকান পোড়ার গন্ধ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সেদিন শাপলা চত্বরের সেই মহাসমাবেশে উপস্থিত আলেমদের দমাতে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পূর্ণশক্তি নিয়ে মাঠে ছিল। নিরীহ ও নিরস্ত্র আলেমদের ওপর অস্ত্র, লাঠিসোটাসহ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ফলে রাজধানীর যেখানেই হেফাজত অনুসারীদের পেয়েছে, সেখানেই আধমরা করে ছেড়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ওইদিন রাত ১১টা। গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধতন কর্মকর্তারাসহ র‌্যাব, পুলিশ বিজিবির নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর একটি টিম শাপলা চত্বরের আশপাশ রেকি করে যায়। এরপর রাত সাড় ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখান থেকে নির্দেশ দেন যে, রাত ১২টার মধ্যে আলেমদের মতিঝিলের শাপলা চত্বর ছেড়ে যেতে হবে। স্বজ্ঞানে তারা চলে না গেলে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন। এরপর রাত যতই গভীর থেকে গভীর হতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়ন ততই বাড়তে থাকে।

দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির বরাত দিয়ে হেফাজত নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে একের পর এক আলেম শহিদ হতে দেখেছি। যা টিভিতে সরাসরি লাইভ দেখানো হয়েছে। ওইসব শহিদ ভাইয়ের লাশ নিয়ে সাথী ভাইয়েরা মিছিল করেছে। আমরা সরকারকে বারবার বলেছি, আল্লামা শাহ আহমেদ শফী হুজুর আসবেন। উনি বক্তব্য দেওয়ার পর আমরা চলে যাব। কিন্তু সেদিন সরকার আমাদের কোনো কথাই শোনেননি।’

মুফতি ফয়জুল্লাহ আরও বলেন, ‘এর পর ওইদিন রাতে কী ঘটেছিল তা অনেকেই জানেন। তবে অনেকের কাছে সেদিন রাত ছিল এক অজানা অধ্যায়। গভীর রাতে মতিঝিলসহ আশপাশের বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করে নিরীহ আলেমদের ওপর নিষ্ঠুর ‍ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সরকার। শত শত ভাই শহিদ হয়েছেন। একইসঙ্গে কয়েক হাজার হেফাজত অনুসারী আহত হন সেদিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেদিন রাতে শুধু হতাযজ্ঞেই মেতে থাকেননি, এমনকি পরদিনও বিভিন্নভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মাদরাসাগুলোতে পুলিশ অভিযানের নামে নির্যাতন করা হয়েছে। বহু আলেমকে ধরে কারাগারে দিয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে হেফাজতের উদ্যোগকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে সরকার।’

তবে এত কড়াকড়ির পরও ‘অধিকার’ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন জানায়, ৫ মে হেফাজতের মহাসমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৬১ জন নিহত হন। অন্যদিকে সরকার দাবি করে, মোট চার জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে দু’জন নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছেন। আর দু’জনের মৃত্যু হয়েছে রাজধানীতে।