শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশে ঈদ

আ ক ম আশরাফুল হক

ঈদ একটি নির্মল আনন্দ উৎসব। কুসংস্কারমুক্ত মননশীল ও বর্ণবৈষম্যহীন উৎসব হচ্ছে ঈদ। উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্রয় যেখানে নেই। ঈদ আমাদের জীবনে বছরে দুবার আসে। প্রথমত দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মনকে পূত-পবিত্রকরণের মধ্য দিয়ে আসে ঈদুল ফিতর। দ্বিতীয়ত সত্যের জন্য যে কোন ধরনের ত্যাগ-তীতিক্ষার ডাক নিয়ে আসে ঈদুল আযহা বা কোরবানীর ঈদ।
ঈদ সবার জন্যই বয়ে নিয়ে আসে আনন্দ ও খুশি। সমতা ও উদারতার উৎসব ঈদ। যাতে ছোট-বড়, সাদা-কালো, ধনী-গরীব, রাজা-প্রজার কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই তাতে সমভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশে অনেক উৎসবই আছে তন্মধ্যে ঈদ উৎসবই হচ্ছে সর্ববৃহৎ। যার তাৎপর্য এ দেশের সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদ যে কেবলই উৎসব তা নয়; বরং তা বাংলাদেশী সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। ঈদ বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে করেছে অনন্য ও সমৃদ্ধ। করেছে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত। কেননা, ঈদ সমগ্র মুসলিমবিশে^ একই সাথে একইভাবে উদযাপিত হয়।
ঈদ আসার প্রায় মাসখানেক পূর্ব থেকে চলে ঈদ পালনের পূর্বপ্রস্তুতি। দুটি ঈদে দেখা দেয় দুটি ভিন্ন দৃশ্য, ভিন্ন চিত্র ও ভিন্ন দুটি আমেজ। কিন্তু তারপরও ঈদ দুটিতেই দেখা যায় মর্মবাণী ও প্রতিপাদ্য বিষয়ে এক অপূর্ব অভিন্নতা, যা সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণকে করে নিশ্চিত। জন্ম দেয় সাম্য ও মৈত্রীর। ঈদ আসার অনেক পূর্ব থেকে এ দেশের মানুষ পরিকল্পনা নেয় ঈদ উদযাপনের। মনের কম্পিউটারে ঈদ উদযাপনের ডিজাইন করে নেয় বেশ যতœ করেই। তাই মাসখানেক পূর্ব থেকেই শুরু হয় ঈদের আয়োজন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সমস্ত শহর-বন্দর এবং প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলের হাটবাজার ও মার্কেটগুলো পরিগ্রহ করে নতুন রূপ। প্রতিটি মার্কেট, প্রতিটি দোকান ঈদ উপলক্ষে করা হয় আলোকোজ্জ্বল ও সুসজ্জিত। নিজের জন্য, প্রিয়জনের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য শুরু হয় কেনাকাটা। ঈদ উদযাপনের আয়োজন বা কেনাকাটার এতই ধুম পড়ে যে, মার্কেটগুলোর সামনে যানজট ও মানবজটে রাজধানী ঢাকা শহর ঈদের প্রায় পনের দিন পূর্ব থেকে অচল হওয়ার উপক্রম হয়।
অন্যদিকে ‘ঈদুল আযহা’ বা ‘কোরবানির ঈদে’র সময় পরিলক্ষিত হয় ভিন্ন আরেক মনোরম দৃশ্য। প্রতিটি জনবসতিতেই অস্থায়ীভবে বসে গরু- ছাগলের হাট। সামর্থ্যবান সবাই পছন্দমতো কোরবানির পশু কেনার চেষ্টা করেন। শহরে কোটিপতির ছেলেও কিছু সময়ের জন্য গরুর রশিতে গ্রাম্য রাখালের কর্মানুভ‚তি উপলব্ধি করে।
অতঃপর শুরু হয় ঈদের মূল পর্ব। সকালে ফজরের নামাযের পরপরই প্রস্তুতি, নুতন জামা-পায়জামা পরিধান করে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করে ঈদগাহের দিকে রওনা। গায়ের আঁকা-বাঁকা, সরু ও প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে দূরে খালি মাঠের দিকে প্রায় একই ধরনের পোশাক পরিহিত মানুষের ঢল যেন এক স্বর্গীয় শোভাযাত্রা। সকাল ৮-৯টায় শুরু হয় সালাতুল ঈদ বা ঈদের নামায। এ এক অপূর্ব মনোরম দৃশ্য। খোলা আকাশের নিচে খালি মাঠে আবাল-বৃদ্ধ সারিবদ্ধভাবে অবস্থান গ্রহণ করে। দু রাকাত সালাত আদায় এবং ইমাম সাহেবের খুতবা প্রদান, অতঃপর বিশ^াসীদের জন্য ক্ষমা, দয়া এবং মঙ্গল ও শান্তি কামনা করে মহান আল্লাহ পাকের কাছে মুনাজাত ও প্রার্থনা।
শহর-নগর ও গ্রামে একই সময়ে একই সাথে একই দৃশ্যের অবতারণা গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করে এক অপরূপ পূত-পবিত্র ও স্বর্গীয় আমেজে। যাতে নেই কোন অপবিত্রতার স্পর্শ, কুসংস্কারের ছোঁয়া। পরিচ্ছন্ন এক আনন্দ উৎসব ঈদ। যা আনন্দের সাথে সাথে মানুষের মন থেকে পাপ পঙ্কিলতা ও হিংসা-বিদ্বেষ বিদূরিত করে।
সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা ঈদ উপলক্ষে প্রকাশ করে বিশেষ সংখ্যা। রেডিও, টিভি আয়োজন করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভবনে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক এবং বিদেশী ক‚টনীতিবিদদের জানানো হয় ঈদ শুভেচ্ছা। জেলখানাগুলোতে পরিবেশন করা হয় উন্নত খাবার। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে ও ভবনে কালিমা তায়্যিবা খচিত পতাকা লাগানো হয়। ঈদে গ্রামবাংলায় নানা ধরনের পিঠা তৈরীর ধূম পড়ে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে ঈদ আপ্যায়ন এবং তাদের ওখানেও ঈদের দাওয়াতে অংশগ্রহণ, জন্ম দেয় সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সহমর্মিতাপূর্ণ এক অনন্য পরিবেশ।
সংস্কৃতি যদি হয় বাস্তবে রীতি পদ্ধতির চিত্র। সংস্কৃতি যদি হয় দেশের জনগণের জীবনের ছবি। সংস্কৃতি যদি হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজনের কৃষ্টির রূপ, তাহলে বলতে হয়, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ঈদের অবস্থান এক নাম্বারে। কেননা, এতেই কেবল সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। দেশে আরো অনেক উৎসবই হয়, তবে সেগুলোতে রাজনৈতিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বর্ণবৈষম্যের কারণে সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়না। কিন্তু ঈদ উদযাপনে কোন বৈষম্য বাঁধ সাধতে পারে না, মানুষের আনন্দ, উৎসাহে চিড় ধরাতে পারে না। ঈদ সব ধরনের বৈষম্যের করে মূলোৎপাটন এবং কায়েম করে সাম্য ও সম্প্রীতি। সুতরাং রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার র‌্যালি বের করা এবং পৌত্তলিকদের উপাস্য বিভিন্ন জীবজন্তুর র‌্যালি বের করা বাংলাদেশের সংস্কৃতি হতে পার না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার যে, বিগত কয়েকবছর যাবত দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিজাতীয় অশ্লীল ও কুসংস্কারপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। রেডিও টিভিতে ঈদ উপলক্ষে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা হচ্ছে ঈদের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ, যা বাংলাদেশের মননশীল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত।

অতএব, ঈদ উপলক্ষে দেশের বেতার টিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানাদি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ঈদের সাথে এবং এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও জীবন রীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে, এটাই বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা।

(লেখক, গবেষক ও মুহাদ্দিস)

এসএসএইচ.