২.
হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে
বন্ধু, কী খবর বল?
কতদিন দেখা হয়নি’
কথাগুলো আমার নয়, কবীর সুমনের। কবীর সুমন মনে করিয়ে দেয়, এই রাস্তাতেই হারিয়ে যাওয়া মুখের সাথে দেখা হয় কদাচিৎ। বাতাসে ভেসে আসে পুরোনো কোনো ভায়োলিনের সুর। এক অদ্ভুত অনুভূতি ছুঁয়ে যায় আমাদের। যে অনুভূতি হয়তো বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।
স্মৃতিরা হাতড়ে বেড়ায়। কত গল্প ভেসে আসে মনের জানালায়। চাইলেই বন্ধ করে দেওয়া যায় না সেই জানালা। বহু বছর পর যেদিন দেখা হয়েছিল আমার বন্ধু রাসেলের সাথে। আমি দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে পারিনি। অথচ এই রাস্তায় কী শঙ্কাহীন কাঁধে হাত রেখে হেঁটে গেছি স্কুলের দিনগুলোতে। রাস্তা কি আমাদের মনে রাখে কিনা জানার উপায় নেই। রাস্তার কাছে থাকে কিনা স্কুলের মতো কোনো হাজিরা খাতা? পুরোনো কেউ হেঁটে গেলে ক্লাসটিচার ফজলুল হক স্যারের মতো টিক চিহ্ন দিয়ে রাখে?
জানি না।
আচ্ছা ফজলুল হক স্যারই-বা কেমন আছে? তার সাথে কী কখনও এই রাস্তায় দেখা হয়ে যেতে পারে?
৩.
রাস্তাতে যেমন পাবার গল্প আছে, হারাবার গল্পও কম না। রাস্তায় চলার পথে কারও কিছু হারিয়ে গেছে শুনলে, আলাদা একটা বিষণ্নতা ভর করে।
একদিন রাস্তায় এক পরিপাটি ভদ্রলোককে দেখলাম, মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে একা একা কী যেন খুঁজছেন সদ্য বিদায়ী শীতের রাতে। কেউ নেই আশপাশে। ইচ্ছে হচ্ছিল জানতে চাই, কী হারিয়েছে?
কিন্তু জানতে গেলে একটা সমস্যাও আছে। শুধু উত্তর না একটা দায়ও চলে আসবে। রাস্তা থেকে দায়ের গল্প নিয়ে বাড়ি ফেরা কঠিন। স্বস্তিতে থাকা যায় না বাড়ি ফিরে। লোকটাকে রেখেই একটা সময় পা বাড়ালাম। নিজেই অবাক হলাম, কী অবলীলায় বিপদগ্রস্ত মানুষকে রেখে চলে এলাম। হয়তো আমার বেলায় ঘটলেও অন্য সবাই এমনই করত। রাস্তায় যার হারায়, সে মূলত একাই হয়ে যায়।
রাস্তার অনেক ক্ষমতা থাকলেও এই একা হয়ে যাওয়া ঠেকানোর ক্ষমতা তার নেই।
৪.
একদিন দেখলাম, দৌড়ে ধরে এক ছিনতাইকারীকে মারছে সবাই। মার দেওয়া একজনের কাছে জানতে চাইলাম, কী করেছে ভাই?
খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলল, নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করছে, নইলে তো সবাই মারত না।
জানতে চাইলেন, আপনি মারলেন কেন?
আরও কনফিডেন্স নিয়ে বললেন, অন্যায়ের সাথে কোনো আপস নাই। কোনো ছাড় নাই। এইভাবে বেঁচে থাকার রাস্তা আমার পরিবার দেখায়নি।
আমি কিছুই মেলাতে পারলাম না। তবে নতুন এক রাস্তার সন্ধান পেয়ে চুপ হয়ে গেলাম।
রাস্তায় এমন গল্প বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমরা হয়ে পড়েছি বিবেচনাবোধহীন। এই রাস্তা পরিহার করা ছাড়া সামাজিক জবাবদিহিতার জায়গাটাও তৈরি করা যাবে না। জানি না কীভাবে হবে, তবে হতে হবে এটা জানি। এর কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের প্রচলিত রাস্তা আনুক শান্তির কোনো রাস্তার সন্ধান।
৫.
হঠাৎ রাস্তায় অনেক মন খারাপ করা গল্পেরও অভাব নেই।
একদিন এক কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষককে পেলাম এক শরবতের দোকানে টুলে বসে আছেন। খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মাথার ওপর প্রখর রোদ। আশপাশে হুহু করে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে বিবেকহীন চালকসমাজ। তবে কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না বোঝা যাচ্ছে। তিনি হয়তো তখন অন্য কোনো সমাজে অবস্থান করছেন।
একটা সময় ফোন বের করে, কাকে কাকে যেন ফোন দিলেন।
প্রথমে দুজনকে ফোন দিলেন। বললেন, মাহবুব সাহেবের অসুখ। অফিসে আসেন না। আর হেডস্যারও আসেন না। ঝামেলায় পড়ে গেছি। কাল কিছু টাকা লাগত। ৫০০ টাকা বিকাশে দিতে পারবা নাকি?
কেউ হয়তো রাজি হলো না। রাজি হলে যে উজ্জ্বল মুখের দেখা মিলত তা হয়নি। চেহারা এখনও সমান বিষাদগ্রস্ত।
আমি আরও গভীরভাবে তাকালাম। মোটামুটি প্রৌঢ় একজন মানুষ। হালকা পাকা দাড়ি। চেহারায় রাজ্যের প্রশ্ন। উত্তর অজানা।
এবার তৃতীয়জনকে ফোন দিলেন। সে লোক শিক্ষক মহোদয় এবং আমাকে একসাথেই বুঝিয়ে দিল, পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর। টাকার কথা শুনে ধুম করেই কেটেই দিল।
শিক্ষক মহোদয় ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আরও মিনিট তিনেক দেখলেন। ফোন ব্যাক করে কিনা।
এলো না। কী মনে করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলেন রাস্তায়।
একটা হাহাকারের পাথর আমার বুকে চেপে রইল। আমার পকেটে তখন বেশ কিছু টাকা। একটা কাজের টাকা পেয়েছি। কয়েকজনকে নিজের হাতে টাকা দিয়েও এসেছি। খুব ইচ্ছে করছিল, ওনাকে থামাই। জিজ্ঞাসা করি, স্যার, কী এমন বিপদ আপনার মাত্র ৫০০ টাকা লাগবে?
করতে পারলাম না। শিক্ষক মানুষ, বেশি আত্মসম্মানবোধ থাকলে ফিরিয়েও দিতে পারেন। এমন দ্বিধায় কী করণীয় জানা নেই। বলা হলো না। মন খারাপকেই বেছে নিতে হলো। দীর্ঘশ্বাস চেপে ধরল।
মনে হলো, ফোন নাম্বারটাও যদি রাখতে পারতাম কিছুটা বেদনা কমত। কাল সকালে একটা ফোন দিয়ে জানতে পারতাম, স্যার টাকাটা কি ম্যানেজ হয়েছে?
৬.
তবে রাস্তার সব ঘটনাই মন খারাপের না। কিছু আছে আনন্দও দেয়। হাসায়। মন ভালো করে। এমন একটা গল্প বলে লেখাটা শেষ করি। গতকাল সন্ধ্যার ঘটনা। এফডিসি রেলক্রসিংয়ে সিগন্যাল পড়েছে।
হঠাৎ ব্যাপক শব্দে গোটা বিশেক মোটরসাইকেল এসে আমার চারপাশে থামল। সামনে একটা প্রাইভেট কার। সম্ভবত কোনো নেতা। আমার পাশের রিকশায় এক মধ্যবয়স্ক চাচা বিষয়টায় খুব আতঙ্কিত। একবার চারপাশে তাকান। একবার আমার দিকে।
কিছুক্ষণ চারপাশ অবলোকন করে স্বর নিচু করে জানতে চাইলেন, এত মোটরসাইকেল কেন? ব্যাপার কি চাচা?
আমি কী বলব ভেবে না পেয়ে বললাম, পাঠাওয়ের মালিক যাচ্ছে সম্ভবত।
চাচা কিছু বললেন না। বিশ্বাস করে ফেলছেন সম্ভবত। বিশ্বাস করা ছাড়া উপায়ও নেই। এই গতির রাস্তায় এক বিষয় নিয়ে পড়ে থাকলে যেমন নিজে আগানো যায় না। তেমনি দেশও আগায় না।
সিগন্যাল উঠে গেল। তিনি এগিয়ে যাবার জন্য প্যাডেলে পা চাপলেন।