স্টাফ রিপোর্টার :
‘বাবা আমি মইরা যামু, আমার লাশটা নিয়া যাইও’-বাবা আবুল হোসেনের সাথে সবশেষ কথা ২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে শহীদ হওয়া নাফিসা হোসেন মারওয়ার। গুলি খাওয়ার প্রায় আধাঘন্টা পর বাবার মোবাইলে মৃদু মৃদু কণ্ঠে একথা বলেছিলেন নাফিসা।
একথা মনে পড়লে স্থির থাকতে পারেন না বলে আমার দেশকে জানান শহীদ নাফিসা হোসেন মারওয়ার পিতা চা দোকানি আবুল হোসেন। তাই প্রায় প্রতিদিনই তিনি কবরে গিয়ে আদরের মেয়ে নাফিসাকে খুঁজে ফেরেন। সন্তানের কথা মনে হলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি।
নাফিসার পিতা আবুল হোসেন কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, আমার ২টা মেয়ে। বড় মেয়ে নাফিসা হোসেন মারওয়া টঙ্গী সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ বিদ্যানিকেতন এন্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সে জিপিএ-৪.২৫ পেয়েছিল। ফল প্রকাশের একসপ্তাহ আগে নাফিসা শহীদ হয়। ছোট মেয়ে সাবা হোসেন রাইসা সাভারে নানীর বাসায় বসবাস করে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। আমি গরীব সহায়-সম্বল বলতে কিছুই নেই। দুইটা মেয়েই আমার সম্বল ছিল। ভাগ্য বদলের আশায় ওদের মা কুলসুম বেগম কুয়েতে পাড়ি জমিয়েছেন ২০২২ সালে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আন্দোলন তো থামল, আমার মেয়ে তো আর আইলো না’। গুলি লাগার পর আমার মা নাফিসা কাতর ও অসহায় কন্ঠে আমাকে ফোনে বলেছে ‘বাবা আমি মইরা যামু, আমার লাশটা নিয়া যাইও’ বলেই মেয়ে ফোনটা রেখে দেয়।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরা আমার মেয়েটাকে বাঁচতে দিলো না। মেয়েটার কথা বারবারই মনে পড়ে।
এঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ ১৪৭জনকে এজাহারনামীয় ও ১৫০-২০০জনকে অজ্ঞাত আসামী করে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাহসিকতার সাথে রাজপথে নেতৃত্ব দেন নাফিসা হোসেন মারওয়া। টঙ্গীর এরশাদ নগর ৮নং ব্লকের একটি ছোট ভাড়া বাসায় ছোট বোন ও চা দোকানি বাবার সঙ্গে বসবাস করতেন।
আন্দোলনের প্রথমদিকে নাফিসা ও তার সহপাঠীরা মেসেঞ্জারে একটি গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে প্রতিদিন মহাসড়কে নামত। তার বাবা সকালে দোকানে চলে গেলে তিনি কাউকে না জানিয়ে আন্দোলনে যেতেন। প্রতিবেশীদের মাধ্যমে মেয়ের আন্দোলনে যাওয়ার খবর শুনে বাবা আবুল হোসেন তাকে বকাঝকা করেন।
একপর্যায়ে ২৮ জুলাই বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে নাফিসা ঢাকার ধামরাইয়ের বড় মামার বাসায় যান, পরে সেখান থেকে ৩০ জুলাই সাভারে ছোট মামার বাসায় ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকেও প্রতিদিন আন্দোলনে অংশ নেন।
৩ আগস্ট বিকেলে আন্দোলনের কিছু ছবি তার বাবাকে পাঠান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার বাবা তাকে বকাঝকা করেন। এরপর ৫ আগস্ট সকালে মামাদের বাধা উপেক্ষা করে সাভারে শিক্ষার্থীদের সাথে লং-মার্চে যোগ দেন নাফিসা।
দুপুর ২টার দিকে নাফিসা তার বাবাকে কল করে জানান, আব্বু, ‘শেখ হাসিনা পলাইছে। জবাবে তার বাবা রাগের মাথায় বলেন, ‘হাসিনা পলাইছে তোর বাপের কী? তোর কিছু হলে কে দেখবে? নাফিসা তার বাবাকে আশ্বস্ত করে জানান ‘আর কিছু হবে না, আব্বু। বড় ভাইয়া-আপুদের সাথে আছি।
এর কিছুক্ষণ পরই সাভার মডেল মসজিদের আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী দোসরদের যৌথ হামলা শুরু হয়। এসময় পুলিশ সরাসরি গুলি চালালে সামনের সারিতে থাকায় নাফিসা বুকে গুলিবিদ্ধ হন। সহযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে সাভার ল্যাবজোন হাসপাতালে নিয়ে যান।
মেয়ের বাসায় ফেরার খবর জানতে নাফিসার মোবাইলে বারবার কল দিচ্ছিলেন তার বাবা আবুল হোসেন। কিন্তু দুপুরের পর থেকে কেউ ফোন রিসিভ করছিল না। এতে তার উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে একটি অচেনা ছেলে কন্ঠ থেকে ফোনে বলা হয়, ‘আপনি ওর কী হন? তাড়াতাড়ি ল্যাবজোন হাসপাতালে আসেন, নাফিসার গায়ে গুলি লেগেছে।
এখবর শুনেই নাফিসার বাবা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তার চায়ের দোকান খোলা রেখেই তিনি সাভারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কিন্তু রাস্তায় কোনো গাড়ি না থাকায় পায়ে হেঁটে ও ভেঙে ভেঙে রিকশায় করে সাভার পৌঁছান।
ল্যাবজোন থেকে নাফিসাকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষণের কারণে অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান।
রাতে সাভারে তার প্রথম জানাজা শেষে টঙ্গীর এরশাদনগরে লাশ নিয়ে আসা হয়। কোনো এম্বুলেন্স না পাওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়ায় পিকআপে করে লাশ আনতে হয়। পরে এরশাদনগরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় নাফিসার লাশ।