রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

জুলাই বিপ্লব ও তার সুফল

আবদুল কাইয়ুম শেখ

ভয়ংকর স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট হাসিনার অহংকার ও একগুঁয়েমির কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। অভূতপূর্ব গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে শহর, উপশহর ও গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র দাবানলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। ছাত্র জনতার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, ড্রাইভার, হকার, রিকশা চালক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। খুনি হাসিনার পেটুয়া বাহিনী ও পুলিশবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শতশত মানুষ হত্যা করেও আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে কারফিউ জারি করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জীবন বাজি রেখে অসম সাহসিকতায় রাজপথ দখল করে কারফিউ ভঙ্গ করার মধ্য দিয়ে হাসিনার মসনদ চূর্ণ করার লক্ষ্যে গণভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। এভাবে অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলার পূর্ব দিগন্তে আবার উদিত হয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য।

দাম্ভিক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার মহাকাব্যিক এই পতনকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ক্ষমতালিপ্সু হাসিনার শাসনামলে (২০০৯-২০২৪) আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশ পরাধীন হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ ও বহু মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ প্রকারান্তরে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। দেশমাতৃকার স্বার্থবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও আজীবন ক্ষমতায় থাকার হীন মানসে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার অবৈধ সরকার ভারতকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সড়ক, রেল ও নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট প্রদান করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বেশকিছু স্থলবন্দর ব্যবহার করার ও বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ভারতের সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে যাতায়াত করার অনুমতি প্রদান করেছিল। হাসিনা সরকার ভারতকে এত দিয়েছিল যে, কোন রাখঢাক না করেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি, সে সারা জীবন মনে রাখবে।’ গণধিকৃত হাসিনার উক্ত কথার মাধ্যমেই অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কতটা হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল! ২০২৪ এর ৫ই আগস্টের মহা বিপ্লবে শেখ হাসিনার লজ্জাজনক পতনের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত হয়েছে এবং ভোটার বিহীন অবৈধ সরকার কর্তৃক ভারতের সঙ্গে কৃত দেশ বিরোধী চুক্তিগুলো বাতিল করার পথ অবারিত হয়েছে।

ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে জেনারেল মুঈনের যোগসাজশে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মানুষের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ.বি.এম খায়রুল হককে দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর ফলে ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালে নৈশভোটের নির্বাচন ও ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন সম্পন্ন করতে সমর্থ হয় ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার অবাধ সুযোগ পায়। যেহেতু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আওয়ামী লীগ সরকার এবং এর মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীরা দেখছিল না তাই তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে সব রকমের অন্যায়, অপরাধ, অনিয়ম, দুঃশাসন, খুন, গুম, অপহরণ ও লুটতরাজে জড়িত হয়ে বাংলাদেশকে ত্রাসের রাজ্যে পরিণত করে। ৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কলঙ্কজনক পতন ও পলায়নের পর বহুল সমালোচিত, নিন্দিত ও ঘৃণিত এই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, অচিরেই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপিত হবে। এতে মানুষের হারানো ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতাসীন হয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।

গণরোষে পতিত শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ কিংবা ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ মূলনীতির পরিবর্তে ভিন্নমত ও দলের লোকদের দমন করার হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। শাসন ক্ষমতার জন্য হুমকিস্বরূপ কিংবা আধিপত্য বিস্তার ও দুঃশাসনের পথে অন্তরায় লোকদেরকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা, গুম, আয়নাঘর ও কারান্তরীণ করাসহ নানাভাবে জুলুম করা হচ্ছিল। ফলে অপরাধের বরপুত্ররা পার পেয়ে যাচ্ছিল এবং নিরপরাধীদেরকে জুলুম, নির্যাতন ও হয়রানীর সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। গণধিকৃত জালিম হাসিনার পলায়নের পর বিচারহীনতার পাগলা ঘোড়ার গতিরোধ হয়। বিচারের বাইরে থাকা দুর্নীতির রাঘব বোয়ালেরা ধীরে ধীরে আইনের আওতায় আসতে থাকে। পতিত হাসিনাসহ তার মন্ত্রী-এমপি ও বহু নেতা কর্মীর নামে হত্যামামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মামলা হয়েছে– যার ফলে অনেকেই রিমান্ড ভোগ করার পর কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। স্বৈরাচার মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসনের এই ধারা অব্যাহত থাকবে এবং অপরাধীরা ন্যায়বিচারের আওতায় এসে নিজ নিজ অপরাধের দণ্ড ভোগ করবে।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সহায় সম্পত্তি লুটপাট করার মহোৎসব চলছিল। উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী এমপি তো বটেই; থানা পর্যায়ের নেতা উপ নেতারাও অবৈধ পথে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতিবাজ হাসিনার গৃহকর্মী ৫০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার কথা খোদ শেখ হাসিনাই গর্ব ভরে জনসম্মুখে উল্লেখ করেছিলেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি, ব্যাংক খাতের দুর্নীতি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ঋণ খেলাপি, সরকারি কেনাকাটায় ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও স্বজনপ্রীতিসহ বালিশ কাণ্ড থেকে নিয়ে পুকুর চুরির মহা লুটপাট শেখ হাসিনার শাসনামলে সম্পন্ন হয়েছে। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পোরেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী কেবল রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প থেকেই টিউলিপ সিদ্দীকির মধ্যস্থতায় ৫০০ কোটি ডলার বা বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রায় ষাট হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় বাংলাদেশের ঋণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনকালে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লক্ষ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের আত্মসাৎ, লুটপাট ও অর্থ পাচারের দরুন ১৫ বছরে বাংলাদেশের ঋণ বেড়েছে ১৫ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এই পরিসংখানের প্রতি লক্ষ্য করে শেখ হাসিনার শাসনামলে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচার হাসিনার উৎখাত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎসহ সব ধরনের অর্থ কেলেঙ্কারির রকেটীয় গতি রুদ্ধ হয়েছে এবং পাচার হয়ে যাওয়া দেশের সম্পত্তি ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাসন ক্ষমতাকে আজীবন টিকিয়ে রাখার জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি তার শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) ৪টি পত্রিকা ছাড়া বাংলাদেশের সকল পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই পত্রিকাগুলোও সরকারের ইচ্ছার বাইরে সংবাদ প্রচার করতে পারত না। ২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাবার দেখানো পথেই হাঁটেন পতিত শেখ হাসিনা। তিনিও ২০১৩ সালে দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি ও ইসলামী টিভি বন্ধ করে দেন। সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচিত করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (Digital security act) প্রণয়ন করেন। এ কারণে সাংবাদিকদেরকে কলম ধরতে বারবার ভাবতে হতো। সত্য লেখার কারণে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানসহ বহু সাংবাদিককে কারাবরণ করতে হয়েছে। সাগর রুনিকে জীবন দিতে হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখার কারণেও কারাবরণসহ হয়রানির শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনে বাংলাদেশের পট পরিবর্তন হয়েছে। টিভি চ্যানেল ও পত্রিকাগুলো স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রচার করতে পারছে। লেখক ও সাংবাদিকগণ নির্ভয়ে কলাম লিখছেন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশ করে চলেছেন। বেআইনিভাবে বন্ধ করে দেওয়া পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো খোলার পথও অবারিত হয়েছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা, ক্রসফায়ার, গ্রেফতার, কারাগারে নিক্ষেপ, ব্যাংক লুট, রিজার্ভ লুট, মানি লন্ডারিং, মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সঙ্কট, প্রতিপক্ষ দমন, দুর্বৃত্তায়ন, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, ভিন্নমত উৎপাটনের চেষ্টা, শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস, নির্বাচন কমিশন ধ্বংস, বিচার বিভাগ ধ্বংস, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, নদী দখল, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আত্মসাৎ, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম, কানাডায় বেগমপাড়া, হেলমেট বাহিনী, গুণ্ডাবাহিনী, হাতুড়িলীগ, ধর্ষণে সেঞ্চুরি ও পুলিশবাহিনীকে আওয়ামী বাহিনীতে পরিণত করাসহ হেন অপরাধ নাই যা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও ছত্রছায়ায় করা হয় নাই। চরম নিপীড়ক ও রক্তপিপাসু স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক পতনে এসব দুর্নীতি ও অপরাধ বন্ধ করে বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

লেখক:
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা-১২১১