মুক্তবাণী অনলাইন : কাশ্মীরে হামলায় সাময়িক যুদ্ধের পর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা কমলেও এখনো ঘটনার রেশ কাটেনি। কাশ্মীর ইস্যুতে যে-ই মুখ খুলছে তার কপালেই জুটছে দেশটির উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘কুঠারাঘাত’। রোষানলে পড়ছে ক্ষমতাসীন বিজেপির কট্টর নেতা-কর্মীদের। মতপ্রকাশ করতে পারছেন না লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদরা। বাদ পড়ছেন না সাংস্কৃতিক কর্মীরাও। ১৫২, ১৯৬, ৩৫৩ ধারায় দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা। সব মিলিয়ে ভারতের বাকস্বাধীনতার শেকড়ে রীতিমতো ‘কুড়াল’ মারছে ক্ষমতাসীন মোদি সরকার। আলজাজিরা, এনডিটিভি।
গত কয়েক দিনে দেশটিতে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কথা’ বলার অভিযোগে একাধিক শিক্ষাবিদ বা সাংস্কৃতিক কর্মীর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। আর এতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির বুদ্ধিজীবী মহলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু প্রশ্ন তোলায় গত রোববার আলী খান মাহমুদাবাদ নামের একজন শিক্ষাবিদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহ’ মামলা করা হয়েছে। তাদের অপরাধ-স্থানীয় এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী উপমহাদেশের বিশিষ্ট কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের একটি গান গেয়েছিলেন। যে গানটি তারা গেয়েছিলেন, সেটি হলো ‘হাম দেখেঙ্গে, লাজিম হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে’। অর্থাৎ ‘আমরাও দেখব, কাজটা সঠিক হচ্ছে কিনা।’ ১৯৭৯ সালে বামপন্থী কবি ফয়েজের লেখা এই গান ভারত ও পাকিস্তানে বিভিন্ন শিল্পী এবং গণসংগঠন বারবার গেয়েছে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এই ইস্যুতে আরও এক ভুক্তভোগী কাশ্মীরি বংশোদ্ভ‚ত ব্রিটিশ অধ্যাপক ও লেখক নীতাশা কৌল (৪৯)। তার জন্য এখন রীতিমতো ‘মাতৃভূমি নিষিদ্ধ’। নীতাশার ওভারসিজ সিটিজেনশিপ অব ইন্ডিয়া (ওসিআই) বাতিল করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ, এখন থেকে নিজের ‘মাতৃভূমি তার জন্য নিষিদ্ধ’। মন চাইলেও আর আসতে পারবেন না কখনো। লেখক নীতাশা অভিযোগ করে বলেছেন, ‘ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড’ চালানোর অভিযোগে তার ওসিআই বাতিল করা হয়েছে। মূলত স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশের জন্যই মোদি সরকার এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। রোববার কৌল তার ওসিআই স্ট্যাটাস বাতিলের সরকারি নোটিশটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। সেইসঙ্গে ভারত সরকারের পাঠানো সরকারি চিঠির একটি অংশের ছবিও সংযুক্ত করেন। এক্স-এ দেওয়া ওই পোস্টে নীতাশা লেখেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ নোট-আজ আমার ওসিআই বাতিল করা হয়েছে। মোদি সরকারের সংখ্যালঘু ও গণতন্ত্রবিরোধী নীতি নিয়ে লেখালেখির কারণে আমাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এটা প্রতিশোধমূলক, নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত।’
কর্নাটক রাজ্য কংগ্রেস সরকারের আমন্ত্রণে বেঙ্গালুরুর এক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন নীতাশা। তবে অভিবাসন দফতরের কর্মকর্তারা তাকে বিমানবন্দরে আটকান। লেখকের দাবি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে হেনস্তার পরে তাকে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠানো হয়।
ভারত-পাকিস্তান হামলা-পালটাহামলার পর মোদি সরকারের ভয়ে ট্যাটু মুছে ফেলছেন কাশ্মীরি তরুণরা। এক সময় অনেক কাশ্মীরি তরুণই তাদের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রতীকী হিসেবে ট্যাটু ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন সেসব মুছে ফেলছেন তারা। কেউ করছেন নিরাপত্তার কারণে, কেউবা চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কায়। রীতিমতো হিড়িক পড়ে গেছে পুরো জম্মু-কাম্মীর জনপদে। বাহু থেকে ট্যাটু মুছে ফেলা ১৭ বছর বয়সি এক কাশ্মীরি তরুণ বারামুল্লার ইরফান ইয়াকুব বলেন, ‘একসময় একটি বিদ্রোহীর নাম ছিল হাতে। এখন মনে হয় আমি অনেক বদলে গেছি। পরিবার, চাকরি, ভবিষ্যতের চিন্তা এসব মাথায় রেখে পুরোনো চিহ্ন মুছে ফেলাই ভালো।’ কিন্তু একসময় এই ট্যাটুই ছিল তার সাহসের পরিচয়। এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতীতের এক ছায়া, যা তার ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। শোপিয়ানের বাসিন্দা রইস ওয়ানিও আতঙ্কে মুছে ফেলছেন ট্যাটু।