রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষার বিভাজন ও রাষ্ট্রের দায়

সৈয়দ শামছুল হুদা

বাংলাদেশে শিক্ষার বিভাজন জাতিকে স্থায়ী বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এ বিভক্তি সমাজে বৈষম্য তৈরি করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ত্রিমুখী শিক্ষা বিদ্যমান। এসব বিভক্তিমূলক শিক্ষার কারণে ছোটকাল থেকেই পরস্পরের মধ্যে এক ধরনের অলিখিত দূরত্ব নিয়ে তরুন প্রজন্ম বেড়ে উঠে। এর প্রভাব থাকে আজীবন। স্বাধীনতার এত বছর পরও ত্রিমুখী এই শিক্ষা ধারাকে কাছাকাছি টেনে আনার কোনো উদ্যোগ তো গ্রহণ করা হয়-ই নাই, উপরুন্তু প্রতিদিন দূরত্ব বাড়ছে বৈ কমছে না। এর কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভাব তৈরি হচ্ছে না। দেশের ত্রিমুখী শিক্ষা ধারার মধ্যে সরকারী যে শিক্ষা সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পুরোপুরি রয়েছে। জেনারেল শিক্ষা হিসেবে সবাই এটাকে চিনে। অপরদিকে রয়েছে মাদরাসা শিক্ষার দুটো ধারা। একটি সরকারি, অপরটি বেসরকারি। যেটা আলিয়া ও কওমী মাদরাসা হিসেবে পরিচিত। আলিয়া মাদরাসার ওপর সরকারের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকলেও কওমী মাদরাসার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যদিও ‘আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ তথা কওমী মাদরাসা সমূহের একটি উচ্চতর বোর্ড এর মাধ্যমে সরকারের সাথে কিছুটা সম্পর্ক আছে। এই উচ্চতর কর্তৃপক্ষ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ পরীক্ষার আপডেট শেয়ার করার করে থাকেন।

মাদরাসা শিক্ষা হিসেবে দেশে আলিয়া মাদরাসাগুলো যথাযথ দীনি চাহিদা পূরণে অনেকটাই ব্যর্থ। জেনারেল এবং ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে আলিয়া মাদরাসাগুলোর সিলেবাস, নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রয়েছে। ফলে এখানে আসলে ঠিকমতো কোনোটাই গণমানুষের আকাঙ্খা পূরণ করতে পারছে না। আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বর্তমান একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, তারা আলিম পাশ করে কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে ছুটতে থাকে। ফাজিল এবং কামিলে ছাত্র সংখ্যা একেবারেই কমে যায়। ঐতিহাসিকভাবে সরকারি কাজ-কর্মে মুসলমানদের সুযোগ দিতেই আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট অনেকটাই এরকম ছিল যে, মুসলিম পরিবারের সন্তানরা একদিকে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ পাবে, অপরদিকে সরকারি চাকুরি ইত্যাদিতেও তারা অবদান রাখবে। বর্তমানে অধিকাংশ ছাত্রের স্বাভাবিক ঁেঝাক হয়ে গেছে, যে কোনোভাবে শিক্ষার শেষ ধাপগুলো কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় থেকে শেষ করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ গ্রহণ করা। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু দেশের জাতীয় ব্যাধি নকল আমাদেরকে শেষ করে দিচ্ছে। অধিকাংশ ছাত্রের মধ্যে এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় দুর্বলতাও এ জন্য দায়ী। আর এসব কারণে যে কোনো মূল্যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণই থাকে সকলের চাওয়া। এজন্য এখানে কুরআন ও হাদীসের চর্চার ঘাটতি থেকে যায়। আলিয়া মাদরাসার সিলেবাস সুন্দর। জেনারেল ও কুরআন হাদীসের সমন্বয়ে তৈরি হলেও অধিকাংশ শিক্ষকদের দুর্বলতা, রাষ্ট্রীয় ব্যাধি ইত্যাদি কারণে এখান থেকে ভালো আলেম তৈরি হচ্ছে না। পাশাপাশি ব্যতিক্রমবাদে অধিকাংশ ছাত্র জেনারেল বিষয়েও দুর্বল থেকে যাচ্ছে।

অপরদিকে দেশের কওমী মাদরাসাগুলোতে ব্যাপক কুরআন ও হাদীস শিক্ষা দেওয়া হয়। সেখান থেকে ভালো হাফেজ, আলেম, মুফাসসির, মুফতি, শায়খুল হাদীস তৈরি হচ্ছে বটে, কিন্তু তারা জেনারেল শিক্ষায় একেবারেই দুর্বল থেকে যাচ্ছে। মাতৃভাষা চর্চা কিছুটা বাড়লেও এখনো কাঙ্খিত মানে পৌঁছেনি। ফলত: তাদের দীনি জ্ঞানের চাহিদা পূরণ হলেও জাতীয় চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে তারা থেকে যাচ্ছে পশ্চাতে। একটা সময় পর্যন্ত এটা স্বাভাবিক ছিল যে, কওমী মাদরাসা থেকে শুধু আলেম তৈরি হবে, তারা মানুষকে দীন বুঝাবে। কুরআন ও হাদীস বুঝাবে। কিন্তু বর্তমানে কওমী মাদরাসাগুলোতে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করছে। এর সবাইকে তো মাদরাসার আঙ্গিনায় শিক্ষাকার্যক্রমে সুযোগ দেওয়ার সুযোগই নেই। তাহলে তারা লেখাপড়া শিখে কর্মজীবনে কী করবে? এ বছর বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড এর এক অফিসিয়াল ঘোষণা থেকে দেখা যায়, ২০২৫ সনে অত্র বোর্ড থেকে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল -৩,৪৯,৭৭৬ জন। তার মধ্যে ছাত্র সংখ্যা-১,৪৭,২১২ জন। ছাত্রীর সংখ্যা- ২,০২,৫৬৪ জন। এই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বিপুল এক জনগোষ্ঠী বর্তমানে কওমী মাদরাসায় পড়ে। তারমধ্যে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা আরও বেশি লক্ষ্যণীয়। কওমী মাদরাসাগুলো নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে। এর বাইরে রয়েছে লাখ-লাখ নূরানী, হিফজুল কুরআন মাদরাসার শিক্ষার্থী। এই বিপুল শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। মাদরাসা শিক্ষা থেকে তাদের পক্ষে জেনারেল শিক্ষা অর্জনের কোনো সুযোগ নেই। চাকরি-বাকরির কোনো সুযোগ তাদের নেই। দেশে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে এদের উচ্চশিক্ষার সুযোগও নেই।

এই যে ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে স্থায়ী দূরত্ব তৈরি হয় তিন ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যেই, কেউ কাউকে আপন করে নিতে পারে না। একজন অন্যদের প্রতিপক্ষ মনে করেন। সবাই যার যার জায়গায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এটা কীভাবে হ্রাস করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। দেশের স্বাধীনতার এত বছর পরও এই দূরত্ব দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। এদেশের এলিট শ্রেণির কিছু মানুষ আছেন যারা মাদরাসা পড়–য়া শিক্ষার্থীদের কোনোরূপ ভালো চোখে দেখেন না। তাদের ব্যাপারে একেবারেই জানাশোনা নেই। কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ, তাদের মন-মানস, তাদের বেড়ে উঠার কাহিনী, তাদের শিক্ষা ও কর্মজীবন, তাদের অবদান সব কিছুই যেন একটি শ্রেণির কাছে অজ্ঞাত। অপরিচিত। দেশে যখনই কোনো ধর্মীয় সংঘাত বা ধর্মীয় ইস্যু তৈরি হয়, আর কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের সাথে রাস্তায় নেমে আসে, তখনই মনে হয়- এই জনগোষ্ঠী কীভাবে বেড়ে উঠছে? এরা কারা? এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর খরচই বা কারা বহন করে?

২৪ এর গণঅভুত্থানের পর পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। সেই আন্দোলনে কওমী শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আকারে অংশগ্রহণ করেছে। বরাবরের মতোই তাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। যদিও এই আন্দোলনে তাদের তেমন কোনোই লাভ নেই। বিপরীতে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ কম ছিল। যদিও তারা আন্দোলনের সুফল ভোগ করবে। প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় সঙ্কটে দেশের কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা রক্ত দেয়। ২০১৩ সালেও তারা রক্ত দিয়েছে। তখনও জাতীয় একটি সমস্যার কারণেই তারা রাস্তায় নেমে এসেছিল। শাহবাগীদের আন্দোলন যখন দেশকে চরম অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তখন তাদের ধর্মবিরোধী ইস্যুকে সামনে আনা হয় এবং কওমী ধারার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ দেশের তাওহীদি জনতাকে সাথে নিয়ে রাস্তায় নামেন। মূলত: ২০১৩ সালের শাহবাগীদের বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক। এটাকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলায় রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হওয়ার পরই কওমীভিত্তিক আলেম ও ছাত্রসমাজ রাস্তায় নেমে আসে। তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর সেটা দীর্ঘমেয়াদী ছিল। অনেক রক্ত তাদের দিতে হয়েছে। এর বিনিময়ও তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে পায়নি। এর একটা সমাধান জাতীয় স্বার্থেই হওয়া প্রয়োজন।

রাষ্ট্র চাইলে এক্ষেত্রে স্বউদ্যোগে কিছু সুবিধা দিতে পারে। বিগত সরকার কওমী শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সনদের একটি স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাকে ভিত্তি করেই এই শিক্ষাধারার যারা শিক্ষার্থী তাদেরকে দেশের অন্যান্য ধারায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের একটা সুযোগ দিতে পারে। ধর্মীয় জ্ঞান, আদর্শ, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান সকলের কাছেই স্বীকৃত। এই শিক্ষাধারা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের দেশের মূলধারার যে প্রাথমিক শিক্ষা আছে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। পরীক্ষা সাপেক্ষে তারা যদি উত্তীর্ণ হতে পারে তাদের দিয়ে জেনারেল লাইনে ধর্মীয় শিক্ষার ঘাটতি দূরীভূত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সহানূভূতিশীল হতে হবে। বিগত সরকার তাদের রাজনৈতিক স্বার্থেই হোক, আর যেভাবেই জাতীয় সংসদে বিল পাশের মাধ্যমে কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাকে এগিয়ে নিতে তো এ সরকারের কোনো বাধা নেই। এর মাধ্যমে পারস্পরিক সুসম্পর্ক তৈরি হবে। সমাজের মূলধারার সাথে কওমী তরুন আলেমদের হৃদ্যতা তৈরি হবে। এসব আলোচনা সামনে আসলেই অনেকে নাক ছিটকায়। নীচের শ্রেনিগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই ইত্যাদি অজুহাতে তাদেরকে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়। রাষ্ট্র চাইলে কওমী মাদরাসা কর্তৃপক্ষের যে বোর্ড রয়েছে সেখানে এসব সমমানের শ্রেণিসমূহে পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। রাষ্ট্র চাইলে এটাকে অনুমোদন দিতে পারে। কওমী মাদরাসার বর্তমান মুরুব্বিগণ নানা কাল্পনিক ভয়ে এখনো দেশের লাখ লাখ তরুন প্রজন্মকে রাষ্ট্রকে সেবা দেওয়ার সুযোগ দানে বঞ্চিত করে রেখেছে। কাজটা তাদেরই ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য যে, মুরুব্বীগণ দ্বিমুখি আচরণ করছেন। একদিকে তারা রাজনৈতিক দল গঠন করে জনগণকে তাদের সাথে থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা ক্ষমতায় গেলে জনগণকে কী সেবা দিবেন সেসব বলছেন। অপরদিকে কওমী জগতের বিশাল একটি তরুন জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এসব দূরত্ব কমিয়ে আনতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে।

এসএসএইচ.