সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৯ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৬ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

জামায়াত নেতা এটিএম আজহার কারামুক্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পাওয়া জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম মুক্তি পেয়েছেন। বুধবার সকালে ঢাকার পিজি হাসপাতাল প্রিজন সেল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মুক্তি পান।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার ‘জুডিশিয়াল কিলিং’-এর মৃত্যুদুয়ার থেকে ফিরলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজহার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১২ সালে এটিএম আজহারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দুবছর পর ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আইনি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে আদালতে ন্যায়বিচারের দ্বার উন্মোচন হয়। ফলে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মানবতাবিরোধী সব অভিযোগ থেকে খালাস পান এটিএম আজহার।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই জামায়াত নেতাকে খালাস দেওয়ায় উল্লসিত দলের নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে তার নিজ এলাকায় রংপুরের বদরগঞ্জে। সেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ উচ্ছ্বসিত। বিতরণ করা হচ্ছে মিষ্টি। দেশের বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে আনন্দ শোভাযাত্রা। হাইকোর্ট চত্বরসহ অনেক এলাকায় শোকরানা নামাজও আদায় করেছেন আনন্দিত নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগ গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ পাঁচ শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও দেওয়া হয়েছিল আমৃত্য কারাদণ্ড। পরে তিনি জেলখানায় বন্দি অবস্থাতেই অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান।
মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল ৯টা পার হতেই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের দর্শনার্থী হল কানায় কানায় পূর্ণ হয়। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, সংবাদকর্মী, জামায়াত নেতাদের পদভারে পূর্ণ হলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে একে একে এজলাসে বসেন বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি রেজাউল হক, বিচারপতি এসএম এমদাদুল হক, বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেলেন।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আইনি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর গাজি এমএইচ তামিম। এরপর ৯টা ৫৫ মিনিটে রায় পড়া শুরু হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ে আপিল বিভাগ বলে, আদালত বিচারিক দায়িত্বের গভীর বোধের সঙ্গে স্বীকার করে যে, তার (হাইকোর্টের) পূর্ববর্তী রায়ে তারা এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ ও তাকে দোষী হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আপিল বিভাগের আগের রায়টি দুঃখজনকভাবে গুরুতর প্রকৃতির ফৌজদারি কার্যধারায় যাচাই-বাছাই এবং ন্যায্যতার উচ্চমান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আপিল বিভাগ এটিএম আজহারের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পর্কিত প্রমাণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে তার আগের ব্যর্থতা স্বীকার করছে। এই মৌলিক নীতিগুলো মেনে চলতে ব্যর্থতার কারণে ন্যায়বিচারের প্রতি চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে।
আপিল বিভাগ আরোও দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছে যে, আগের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট এবং রাষ্ট্রপক্ষের মামলার অন্তর্নিহিত প্রমাণের দুর্বলতাগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে এটিএম আজহারকে দোষী সাব্যস্তকরণ এবং তার সাজা আর বহাল রাখা সম্ভব নয়।
রায়ের চারটি পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, প্রথমত আগের রায়ে বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশে ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি চেঞ্জ করে দেওয়া হয়েছিল, এটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। দ্বিতীয়ত, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ এসেসমেন্ট করা ছাড়াই এটিএম আজহারকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়ত, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি বিচারের নামে অবিচার। সর্বশেষ আদালত মনে করেছে, সব তথ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।