রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫ জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

ব্যাবসায়ীদের জন্যে যে কাজগুলো নিষিদ্ধ করেছেন রাসূল(সাঃ)

মুক্তবাণী ফিচার ডেস্ক: ব্যবসা মানেই শুধু পণ্য কেনাবেচা নয়। একজন ব্যবসায়ী একজন মানুষকে কী দিচ্ছেন, কত দামে দিচ্ছেন, কোন মনোভাব নিয়ে দিচ্ছেন এবং তার লেনদেন কতটা স্বচ্ছ—এসবই ইসলামে ব্যবসার নৈতিকতা নির্ধারণ করে। ব্যবসা কখনোই শুধুই লাভ আর ক্ষতির অঙ্ক নয়, বরং এটি একজন মানুষের ঈমানের প্রতিফলন। ইসলাম একজন ব্যবসায়ীর কাছে ন্যায্যতা, সততা, ধৈর্য, সহানুভূতি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রত্যাশা করে। আর এই প্রত্যাশাগুলোর বিপরীতে কিছু আচরণকে রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন।

নিচে ব্যবসায়ীদের এমনই আটটি কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হলো, যেগুলো রাসুল (সা.)’র বাণীতে হারাম বা মারাত্মক গুনাহর আওতায় পড়ে।

মিথ্যা বলা ও পণ্যের দোষ গোপন করা

ইসলামে মিথ্যাচারকে গোনাহে কাবিরা বা বড় গুনাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর যখন এই মিথ্যা ব্যবসার সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা কেবল ব্যক্তির ঈমানই নষ্ট করে না, বরং সমাজে একধরনের অনৈতিকতার সংস্কৃতিও গড়ে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি বিক্রির সময় পণ্যের দোষ গোপন করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবে থাকবে এবং ফেরেশতারা তাকে অভিশাপ দিতে থাকবে।” (ইবনে মাজাহ, ২২৪৭)

এ ধরনের ঘটনার বাস্তব উদাহরণ আমাদের চারপাশেই দেখা যায়। বাজারে অনেক সময় পুরাতন বা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যকে নতুন বলে চালিয়ে দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, এক দোকানি ফ্রিজে রাখা পুরনো মাংস নতুন প্যাকেটে ঢুকিয়ে বলেন, ‘আজ সকালেই কাটা’। ক্রেতা বিশ্বাস করে কিনে নেয় এবং পরে রোগাক্রান্ত হয়। এই প্রতারণা শুধু একটি লেনদেন নয়, এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে খেলা।

প্রতারণামূলক লেনদেন

প্রতারণার চূড়ান্ত পরিণাম এতটাই ভয়াবহ যে রাসুল (সা.) স্পষ্ট বলেন, “যে প্রতারণা করে, সে আমাদের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (মুসলিম, ১০১)

এক সাহাবি হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) একবার খাদ্যের স্তূপে হাত দিয়ে দেখলেন নিচে ভিজা অংশ আছে। তিনি মালিককে প্রশ্ন করলেন, কেন এই অংশ ওপরে রাখা হয়নি? মালিক বললেন, ‘বৃষ্টির জন্য ভিজে গেছে।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, “তবে তুমি কেন সেটা উপরে রাখলে না? যে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (সহিহ মুসলিম, ১০২ বর্তমান বাজারে যেসব বিক্রেতা বাইরের চকচকে মোড়কে নষ্ট পণ্য ঢেকে রাখেন, তারা বুঝে হোক বা না বুঝে, নবীজির (সা.) দল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন।

মজুতদারি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা

মজুতদারি বা হোর্ডিং আজকের বাজার ব্যবস্থায় একটি সাধারণ চর্চা। অথচ এটি এমন একটি কাজ, যাকে নবীজি (সা.) সরাসরি অপরাধ এবং সামাজিক শত্রুতা বলে অভিহিত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য মজুত করে, সে গুনাহগার (ফাসিক)।” (সুনানে নাসাঈ, ৪৪৫২)

আজকের বাস্তবতায় ধরুন, কোনো মৌসুমে চালের দাম কম থাকায় কিছু গুদামদার একত্রে বিপুল চাল মজুত করে। এরপর বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে নিম্নবিত্ত মানুষ কষ্টে পড়ে, আর একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অঢেল মুনাফা তোলে। নবীজি (সা.)-এর দৃষ্টিতে এই কাজটি শুধু নিষিদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজবিরোধী।

ওজনে বা মাপে কম দেয়া

আল্লাহ তাআলা স্বতন্ত্র একটি সূরায় এর ভয়াবহতা উল্লেখ করে বলেন, “ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়।” (সূরা মুতাফ্‌ফিফিন: ১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) যুগেও মক্কা ও মদিনায় ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা ছিল। তিনি এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। আজকের দিনে আধুনিক প্রযুক্তি থাকার পরেও অনেক দোকানে ডিজিটাল মেশিনে হেরফের করে ওজনে কম দেওয়া হয়। বাজারে তেল বিক্রির সময় কিছু দোকানি বোতলের নিচে অতিরিক্ত মোটা তলা বসিয়ে কম দামে কম তেল দেয়। এমন আচরণ শুধু অবৈধ আয় নয়, বরং ক্রেতার প্রাপ্য হক নষ্ট করে দেয়া—যা ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি

হাদিসে এসেছে, “তিন শ্রেণির মানুষ কিয়ামতের দিন আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকবে। তাদের একজন হলো যে মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করে।” (সহিহ মুসলিম, ১০৬)

আসলে আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করা শুধু অপরাধ নয়, তা একটি ভয়াবহ কুঅভ্যাস। যেমন ধরুন, এক ব্যবসায়ী পণ্যের দাম ২০০ টাকা হলেও ক্রেতার সন্দেহ দূর করতে বলে, “আল্লাহর কসম, ২৫০ টাকায় কিনেছি।” এতে শুধু ক্রেতাকে ধোঁকা দেয়া হয় না, বরং আল্লাহর নামকে নিজের লাভের হাতিয়ার বানানো হয়। হাদিসে এর শাস্তি ‘জাহান্নাম’ বলা হয়েছে।

সত্য শপথ করাও অপছন্দনীয়

সত্য বলার ক্ষেত্রে শপথের প্রয়োজনীয়তা তখনই হয় যখন কথার ওপর আস্থা কম থাকে। ব্যবসায় বারবার শপথ করার প্রবণতা বিশ্বাসযোগ্যতা নয়, বরং সন্দেহের সৃষ্টি করে। রাসুল (সা.) বলেন, “শপথ পণ্য বিক্রি বাড়ায় ঠিকই, কিন্তু বরকত বিনাশ করে।” (সহিহ বুখারি)

আজকাল পণ্যের গুণাগুণ বোঝাতে অনেক বিক্রেতা বলে থাকেন, “ভাই, আল্লাহর কসম, এমন জিনিস আপনি আর কোথাও পাবেন না।” অথচ এই কসম একটি চালাকি ছাড়া কিছু নয়। এমন অভ্যাস ব্যবসার প্রতি ক্রেতার আস্থা নষ্ট করে এবং ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদী বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করে।

অন্যের দরদামের ওপর দরদাম করা

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা কেউ যেন অপরের দরদামের ওপর দরদাম না করো।” (তিরমিজি, ২৪২)

ধরুন, একটি মোবাইল ফোন দোকানে এক ক্রেতা ১৫ হাজার টাকায় দরদাম করছেন। এমন সময় আরেকজন এসে বলে, “আমি ১৬ হাজার দেব।” এতে প্রথম ক্রেতা হতাশ হয়ে ফিরে যান, আর বিক্রেতা দাম বাড়িয়ে ফেলে। এই আচরণ বাজারে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা তৈরি করে যা ইসলামী নীতির পরিপন্থী।

সন্দেহজনক বা ‘শুবহা’ লেনদেন

সবসময় একটি লেনদেন স্পষ্টভাবে হালাল বা হারাম বোঝা যায় না। অনেক সময় বিষয়টি অস্পষ্ট থাকে। এই অবস্থায় ইসলাম পরামর্শ দেয়—সন্দেহজনক লেনদেন থেকে দূরে থাকা। রাসুল (সা.) বলেন, “হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্ট। আর এ দুয়ের মাঝে কিছু সন্দেহজনক বিষয় রয়েছে, যেগুলো অনেকেই জানে না। যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় এড়িয়ে চলে, সে নিজের ধর্ম ও সম্মান রক্ষা করে।” (সহিহ বুখারি, ৫২)

বর্তমানে অনেক ‘ডিজিটাল ইনভেস্টমেন্ট’ স্কিম বা ‘ক্যাশব্যাক ব্যবসা’ আছে যেগুলোর প্রকৃত প্রকৃতি অস্পষ্ট। একজন সৎ ব্যবসায়ীর দায়িত্ব এগুলো যাচাই না করে বিনিয়োগ না করা। নতুবা তিনি জেনে বা না জেনে হারামে জড়িয়ে পড়তে পারেন।

উপসংহার

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিনে নবী, সিদ্দিক এবং শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।” (তিরমিজি, ১২০৯) এই একটি হাদিসেই ব্যবসায়িক সততার মর্যাদা ও পুরস্কার ফুটে উঠেছে। একটি সৎ ব্যবসা কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, বরং আত্মার মুক্তি ও জান্নাতের পথ খুলে দেয়। নবীজির (সা.) শেখানো নীতিগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং একটি আদর্শ সমাজ গড়ার ভিত্তি। সৎ ব্যবসায়ী সমাজের বন্ধু, রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং উম্মাহর অহংকার।