সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৩ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২ সফর, ১৪৪৭ হিজরি

ডেঙ্গুর ছোবলে দেশজুড়ে উদ্বেগ: মৃত্যু বাড়ছে , লার্ভা ছড়াচ্ছে, দমন ব্যবস্থায় ভাটা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। বছরের প্রথম ছয় মাস পার হতে না হতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৩,৯৭২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩১ থেকে ৩৪ জনের। বিশেষ করে বরগুনা, বরিশাল ও আশেপাশের উপকূলীয় অঞ্চলে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। বরগুনা জেলায় একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও তার সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সরকারি হিসেবে কম থাকলেও প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে লার্ভার আধিক্য বাড়ছে এবং নির্মাণাধীন ভবন, ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনে এডিস মশার বংশবিস্তার অব্যাহত রয়েছে।

তবে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে তা হলো ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনার কাজ, অর্থাৎ “ডেথ রিভিউ” কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর জানায়, অর্থের অভাবে এ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ আছে। ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ ঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ডেঙ্গুতে কার কীভাবে মৃত্যু হচ্ছে, চিকিৎসা ব্যবস্থায় কী সমস্যা, তা বোঝা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এ বছর ঢাকায় উচ্চ ভবন ও নির্মাণাধীন স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভার হার বাড়ছে। লার্ভা জরিপ অনুযায়ী, বহুতল ভবনে লার্ভার উপস্থিতি ৫৮ শতাংশের বেশি এবং নির্মাণাধীন ভবনে প্রায় ২০ শতাংশ। এই তথ্য ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা থেকেই মূলত সংক্রমণ বাড়ছে।

এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১১ সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে, যারা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় লার্ভা ধ্বংস, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ফগিং কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার ফলাফল দৃশ্যমান নয়। বিশেষ করে বরিশাল ও বরগুনার মতো এলাকায় ICU সুবিধার অভাব, পর্যাপ্ত বেড না থাকা এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসক সংকট ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এই সময়ে যেখানে রোগীর সংখ্যা ছিল ২,৮৫৩, সেখানে ২০২৫ সালের একই সময়ে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩,৯৭২ জনে, অর্থাৎ সংক্রমণ বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। তবে আশার কথা, গত বছরের তুলনায় এ বছর মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে। ২০২৪ সালের এই সময়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪১ জন, যেখানে ২০২৫ সালে তা ২৩ জনে নেমে এসেছে। তবে বছরের অর্ধেক সময়ও পেরোয়নি, ফলে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দ্রুত ডেথ রিভিউ চালু না হলে, আক্রান্ত ও মৃতদের বিশ্লেষণ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকলে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেবল চিকিৎসা দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়—বরং পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা এবং কার্যকর কৌশল প্রয়োগই হতে পারে একমাত্র পথ।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে দ্রুত, কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে—যাতে বর্ষাকালজুড়ে এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং নতুন করে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে, নতুবা ডেঙ্গু শিগগিরই সারাদেশে মহামারির রূপ নিতে পারে