ভূমি-সংক্রান্ত সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে ভূমি অফিস নির্মাণ। সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে এই ভূমি অফিস নির্মাণের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি কোড জটিলতা ও অপরিকল্পিত ব্যয় বরাদ্দের কারণে থমকে গেছে। ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের হাতে নেওয়া ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার এই প্রকল্প এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ, পরামর্শকের অভাব এবং প্রশাসনিক দেরির কারণে ভূমিসেবা ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি শুধু সময় ও অর্থের অপচয়ই নয়, বরং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবকেও তুলে ধরছে। শুক্রবার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পের প্রথম ধাপে ১ হাজার ৫০টি ভবন নির্মাণের জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হলেও দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ৩৩৩টি ভবনের জন্য কোনো পরামর্শকের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে ফাউন্ডেশন, মাটি পরীক্ষা, ডিজাইন ও ড্রইংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সময়মতো সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) স্পষ্ট জানিয়েছে, পরামর্শকের অভাবে প্রকল্পের কাজ সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পের ডিপিপিতে অর্থনৈতিক কোডগুলোতে অসংগতি, অতিরিক্ত বা কম বরাদ্দের সমস্যা প্রকল্প বাস্তবায়নকে আরও জটিল করেছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রকল্পটি দায়সারাভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের আগে যথাযথ পরিকল্পনা ও বিশ্লেষণের অভাবে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যা সময় ও অর্থের অপচয় ডেকে আনছে। এখানে দায় রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনেরও। তারা প্রকল্পের ডিপিপি পর্যালোচনায় যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। প্রকল্প পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেনের বক্তব্যে উঠে এসেছে, গত ৯ মাস ধরে দৈনিক মজুরি কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, যা তাদের মানবেতর জীবনযাপনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ইন্টারনেট লাইনের ভাড়া পরিশোধেও সমস্যা হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে ডিপিপি সংশোধন এবং নতুন অর্থনৈতিক কোড সংযোজনের প্রস্তাব করা হলেও প্রশাসনিক জটিলতা এই প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে। ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ নির্ধারিত হলেও সরকারি আদেশ জারিতে আট মাস বিলম্ব এবং প্রশাসনিক আদেশ জারিতে আরও বিলম্বের কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোনো বরাদ্দ রাখা সম্ভব হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ব্যয়ে জটিলতা রয়ে গেছে। এই ধরনের অপরিকল্পিত পদক্ষেপ জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার যে ঘাটতি রয়েছে, তা প্রকাশ করে। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী ঠিকই বলেছেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। একই ভুল বারবার করা কেবল অর্থের অপচয়ই নয়, বরং জনগণের প্রতি অবিচার। তিনি তদারকি সংস্থা আইএমইডির মূল্যায়নের ভিত্তিতে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল এড়ানো যায়। এই প্রকল্পের ব্যর্থতা শুধু প্রশাসনিক অদক্ষতারই প্রতিফলন নয়, বরং সরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবকেও তুলে ধরে। ভূমিসেবা জনগণের মৌলিক প্রয়োজন। এই সেবা ব্যাহত হওয়া মানে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধি। প্রকল্পের সংশোধন ও নতুন পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। সেই সঙ্গে দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
পরিকল্পনা কমিশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই এই প্রকল্পের ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। নতুন অর্থনৈতিক কোড সংযোজন, পরামর্শক নিয়োগ এবং প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের আগে পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের অর্থের সঠিক ব্যবহার ও তাদের সেবা নিশ্চিত করাই এখন সরকারের প্রধান দায়িত্ব।