লে. অব. আবু রূশদ
কোন দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার পাঁচ জন প্রধানকে একসাথে মানবতা বিরোধী তৎপরতায় জড়িত থাকার অপরাধে সমন জারির ঘটনা পৃথিবীতে কখনো ঘটেনি। এবং এরা সবাই ছিলেন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র‘ এর তৎপরতা নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য এন এস আই ও ডিজিএফআইয়ের পাঁচ জন সাবেক মহাপরিচালকের সাক্ষাতকার নিতে হয়েছিল আমাকে। এছাড়া আরো কয়েকজনকে কাছে থেকে দেখেছি। ‘র‘ নিয়ে বই লেখার সময় এনারা বহু অজানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন।
তাদের কাউকে কাউকে নিয়ে রাজনৈতিক সমালোচনা ছিল, আছে। কিন্তু আমি তাদের প্রত্যেককে দেখেছি সৎ, দেশপ্রেমিক ও পেশাদার হিসেবে। বিশেষ করে ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তারা ছিলেন পূর্ণ পেশাদার।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের কোর্স মেট ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের রেডিও অফিসার মেজর জেনারেল এম এ হালিম, লে. জেনারেল নাসিম বীর বিক্রম, মেজর জেনারেল ইমামউজ্জামান বীর বিক্রম, মেজর জেনারেল এম এ মতিন বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল নজরুল ইসলামের মতো অফিসাররা কখনোই ডিগনিটি বিসর্জন দেননি, মানবতাবিরোধী কোন কাজ করেননি। তারা যা করেছেন তা দেশের স্বার্থে।
উনাদের মধ্যে জে. হালিমের বাড়ি গোপালগঞ্জ যিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ডিজি নিযুক্ত হন। এর আগে বিএনপির সময় উপমহাপরিচালক ছিলেন। তিনি কখনোই কোন অন্যায্য ও অবৈধ রাজনৈতিক আদেশ মানতেন না। অবসরের পর লীগ ক্ষমতায় থাকতেই তিনি ‘র’ তৎপরতা নিয়ে আমাকে সাক্ষাতকার দেন। জে. নজরুলও লীগ সরকারের সময় ডিজি ছিলেন। আমি নিজে স্বাক্ষি তিনি কিভাবে সশস্ত্রবাহিনী ও দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছেন শত প্রতিকূলতার মধ্যে।
এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুল হক বীর উত্তম ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহু ঘটনার জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৯৭৫ সালের সাত নভেম্বরের বিপ্লবে জাসদের ফাজলামোসহ সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার বহু চক্রান্ত তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুখে দিয়েছেন। অপর একজন ডিজি মেজর জেনারেল গোলাম কাদেরও কখনো তার পদ ব্যবহার করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হননি।
আজও যখন জেনারেল হালিম, জেনারেল ইমামকে দেখি তখন অবাক হই। মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় নিভৃতে সাদাসিধে জীবন কাটান। কোন জৌলুস নেই। পেশাদার সেনা অফিসারের সম্মান নিয়ে জীবন পার করছেন।
কি এমন হলো যে আমাদের সেই সেনাবাহিনীর পাঁচ জন শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাকে আজ দেশের মানুষের সামনে এভাবে বেইজ্জত হতে হচ্ছে!
এই পাঁচ জনের সবাই আর্মি নম্বরে আমার জুনিয়র, কোর্স মেট লে. জেনারেল আকবর সহ। প্রত্যেককেই চিনি মিলিটারি একাডেমি থেকে। এদের প্রত্যেকের সামরিক ক্যারিয়ার যথেষ্ট ভালো ছিল। এমনিতেই এরা উপরে উঠতে পারতেন। হয়তো কেউ লেফটেন্যান্ট জেনারেল না হয়ে মেজর জেনারেল হতেন বা কেউ মেজর জেনারেল না হয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে অবসরে যেতেন। এভাবে অবৈধ রাজনৈতিক আদেশ না মানলে আজ অপদস্থ হতে হতো না। কিন্তু দেখেছি উনারা কিভাবে সীমা অতিক্রম করেছিলেন। অনেকে কিভাবে রাজনীতিবিদদের চেয়ে অতিমাত্রায় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন।আগের ডিজিদের জীবনাচার, পেশাদারিত্ব থেকে কিছু্ই গ্রহন করেননি। আমি নিজেও ওই সময়কার ডিজিএফআইয়ের হাতে যথেষ্ট হেনস্থার শিকার হয়েছি। আমাদের অসংখ্য অফিসার অপমানিত হয়েছেন।
আমাদের কোর্সের সোর্ড অফ অনার মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরে গিয়েছেন, দ্বিতীয় জন লে. জেনারেল পর্যন্ত যেতে পেরেছেন, তৃতীয় জন কর্নেল হিসেবে চাকরি শেষ করেছেন, চতুর্থ জন মেজর পদে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন । আমি কোর্সের প্রথম দিকে থাকার পরও মাত্র লেফটেন্যান্ট হিসেবে অবসরে গিয়েছি । তাতে কি হয়েছে? আমাদের রিজিক তো আল্লাহ বন্ধ করেননি । এই পাঁচ জনের তাহলে মাথায় কি চেপেছিল?
আমাদের পরম প্রিয় সেনাবাহিনীর সকল অফিসারের জন্য এই বিষয়টি একটি শিক্ষা। হাজার হাজার অফিসার ও সৈনিক কতো কষ্ট করে ক্যারিয়ার তৈরি করে, বেতনের মধ্যে সংসার চালায়, পাহাড়ে জীবন দেয়।
আমি সবাইকে অনুরোধ করবো অভিযুক্তদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করবেন না। বরং আমরা খুঁজে দেখতে পারি কেন এই অফিসাররা এমন দানবে পরিণত হলেন। আমরা আরো যেটা করতে পারি তাহলো সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি রাজনীতির বাইরে রাখার উদ্যোগ নিতে পারি। ডিজিএফআইয়ের কাজ তিন বাহিনীর নিরাপত্তা দেখা, দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত গোয়েন্দা কার্যক্রম রুখে দেয়া। তাদের কাজ দেশের রাজনীতিতে সরকারের হয়ে প্রভাব বিস্তার করা নয়। বিরোধী মতের কাউকে গুম করা নয়। এই পরিবর্তন নির্বাচিত একটা সরকারকে প্রয়োজনে ডিজিএফআইয়ের নীতিমালা রদবদল করে করতে হবে। জজবা থেকে রাজনীতি দেখার জন্য আলাদা ব্যুরোর দরকার নেই সেখানে।
সেনা অফিসারদের যেহেতু ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয় তাই তাদের ভবিষ্যৎ দেখার দায়িত্ব সরকারের। আর রাজনৈতিক কারনে সেনা অফিসারদের ব্যবহার না করাই হলো সেই দায়িত্ব।