শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৭ জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ভেনিজুয়েলার নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেলবাহী জাহাজের ওপর ট্রাম্পের ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ ঘোষণা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভেনিজুয়েলায় প্রবেশকারী এবং সেখান থেকে ছেড়ে যাওয়া নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত সকল তেলের ট্যাঙ্কারের ওপর সর্বাত্মক অবরোধের নির্দেশ জারি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের ক্রমবর্ধমান চাপ প্রয়োগ তৎপরতার অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে অবরোধের ঘোষণা দেন ট্রাম্প।

দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, মাদুরোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের তৎপরতার অংশ হিসেবে ওই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভেনিজুয়েলার উপকূলবর্তী প্রশান্ত মহাসাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগরে বিভিন্ন জাহাজের ওপর ইতোমধ্যে বেশ কিছু সামরিক হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব হামলা বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন।

গত সপ্তাহে ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ভেনিজুয়েলা উপকূল থেকে একটি তেলের ট্যাঙ্কার জব্দ করে মার্কিন বাহিনী। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ট্যাঙ্কারটিতে ভেনিজুয়েলার প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ছিল। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই কর্মকাণ্ডকে ‘প্রকাশ্যে চুরি’ এবং ‘আন্তর্জাতিক দস্যুবৃত্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যা দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

অবরোধের ঘোষণা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প অভিযোগ করেন, ভেনিজুয়েলা মাদক পাচার ও অন্যান্য অপরাধে অর্থায়নের জন্য এই তেল ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে (ভেনিজুয়েলা উপকূলে) সামরিক শক্তি আরও জোরদার করার অঙ্গীকার করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় নৌবহর দিয়ে ভেনিজুয়েলাকে সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এই বহর আরও বড় হবে এবং তারা (ভেনিজুয়েলা) এমন এক ধাক্কা খাবে যা তারা আগে কখনো দেখেনি… আজ আমি ভেনিজুয়েলায় আসা-যাওয়া নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত সকল তেলের ট্যাঙ্কারের ওপর “সর্বাত্মক ও সম্পূর্ণ অবরোধ”-এর নির্দেশ দিচ্ছি।’

তবে কীভাবে এই অবরোধ কার্যকর করা হবে এবং গত সপ্তাহের মতো জাহাজ আটকানোর কাজে কোস্ট গার্ডকে ব্যবহার করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন ওই অঞ্চলে হাজার হাজার সৈন্য এবং একটি বিমানবাহী রণতরীসহ প্রায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে।

ভেনিজুয়েলা সরকার ট্রাম্পের ওই আদেশকে একটি ‘জঘন্য হুমকি’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে রয়টার্স।

এক বিবৃতিতে দেশটির সরকার জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে ভেনিজুয়েলার ওপর একটি তথাকথিত নৌ-অবরোধ আরোপ করতে চাইছেন, যার উদ্দেশ্য হলো আমাদের মাতৃভূমির সম্পদ চুরি করা।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে মাদুরো বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী ডানপন্থীরা ভেনিজুয়েলাকে উপনিবেশ বানিয়ে আমাদের তেল, গ্যাস, স্বর্ণ ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ দখল করতে চায়। আমরা আমাদের মাতৃভূমি রক্ষার কঠিন শপথ নিয়েছি এবং ভেনিজুয়েলায় শান্তির বিজয় হবেই।’

টেক্সাসের ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান হোয়াকিন কাস্ত্রো ট্রাম্প প্রশাসনের এই অবরোধকে ‘নিঃসন্দেহে একটি যুদ্ধসুলভ আচরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বলেন, এটি এমন এক যুদ্ধ, যার অনুমোদন কংগ্রেস কখনো দেয়নি এবং আমেরিকার জনগণও তা চায় না।

তেলের বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, ভেনিজুয়েলার তেল রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তেলের দাম বাড়ছে। তবে তারা ট্রাম্পের এই অবরোধ কীভাবে কার্যকর হবে এবং নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকা জাহাজগুলোর ওপরও এই অবরোধ প্রযোজ্য হবে কি না, তা দেখার অপেক্ষায় আছেন।

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র একটি তেলের ট্যাঙ্কার জব্দের পর থেকে সেখানে কার্যত একটি অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা চলছে। লাখ লাখ ব্যারেল তেলবাহী জাহাজগুলো জব্দ হওয়ার ভয়ে ভেনিজুয়েলার জলসীমাতেই অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র ওই জাহাজটি জব্দ করার পর থেকে ভেনিজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

অন্যদিকে, ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পিডিভিএসএ-এর প্রশাসনিক ব্যবস্থা সাইবার হামলার শিকার হয়ে অকেজো হয়ে পড়ায় এই সপ্তাহে তেল রপ্তানি আরও কমেছে।

ভেনিজুয়েলা থেকে তেল সংগ্রহকারী অনেক জাহাজ নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকলেও ইরান ও রাশিয়া থেকে দেশটির তেল ও অপরিশোধিত তেল পরিবহনকারী অন্য জাহাজগুলো নিষেধাজ্ঞার বাইরে রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শেভরনের মতো কিছু কোম্পানি তাদের নিজস্ব অনুমোদিত জাহাজে করে ভেনিজুয়েলার তেল পরিবহন করে থাকে।

বর্তমানে তেলের বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে এবং লাখ লাখ ব্যারেল তেল চীনের উপকূলে খালাসের অপেক্ষায় আছে। তবে যদি এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে দৈনিক প্রায় ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ কমে গিয়ে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত কয়েক মাস ধরে ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছেন ট্রাম্প। মঙ্গলবার পেন্টাগন জানায়, প্রশান্ত মহাসাগরে মাদক পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত তিনটি নৌকায় তারা হামলা চালিয়েছে এবং এ হামলায় আটজন নিহত হয়েছেন। ভেনিজুয়েলার উপকূলবর্তী এলাকায় গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২০টিরও বেশি হামলায় অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা ২ সেপ্টেম্বরের হামলার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথ তা প্রত্যাখ্যান করে ভিডিওটি ‘অতি গোপনীয়’ বলে অভিহিত করেন। তার দাবি, এটি জনসমক্ষে প্রকাশ করলে মার্কিন যুদ্ধ বিভাগের দীর্ঘদিনের নীতির লঙ্ঘন হবে।

ট্রাম্প প্রশাসন তাদের এসব প্রচেষ্টাকে সফল দাবি করে জানায়, এর ফলে মাদক আমেরিকার উপকূলে পৌঁছাতে পারছে না। একই সঙ্গে তারা আইনসিদ্ধ যুদ্ধের সীমা অতিক্রম করার যে উদ্বেগ আছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রশাসন বলে আসছে যে, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মাদক চোরাচালান বন্ধ করা।

তবে ভ্যানিটি ফেয়ারে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের চিফ অফ স্টাফ সুজি উইলিস নিশ্চিত করেছেন যে, এই অভিযান মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টারই একটি অংশ। তিনি বলেন, যতক্ষণ না মাদুরো নতি স্বীকার করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত জাহাজে হামলা অব্যাহত রাখতে চান ট্রাম্প।